(গত সংখ্যার পর)
জাকির সাহেব তার জরিপের কাজ তখনও শেষ করতে পারেনি।
সুমি বলল, ‘কী নির্জন গ্রাম। প্রকৃতি এখানে ক্যামন নিস্তরঙ্গ। আর প্রকৃতির সন্তানরা। আহ।’
নাজনীন বলল, ‘আমার গ্রামের মতো!’
উর্মিলা বলে, ‘দিদি, আমি তো এ জীবন দেখিনি।’
আর এ সময় মঞ্জু রহমান দৌড়ে এলেন।
‘বস সবাইকে গাড়িতে উঠতে বলেছে।’
ক্লান্ত, বিষণœ, তিক্ত মন নিয়ে উর্মিলা যখন নাখালপাড়ার বাসায় ফিরে এল তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে।
রুবীর প্রশ্ন করার আগেই উর্মিলা বলল, ‘রুবী, জীবন এতো গ্লানিকর, জানা ছিল না।’
০৬.
অফিসে যাবার আগে বাবার দেয়া পোস্টকার্ডে চোখ বুলিয়ে নেয় উর্মিলা। বাবার জন্য মমতায় বুক টন টন করতে থাকে। বাবা লিখেছে,
‘কল্যাণীয়া উর্মিমালা,
তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি চলিয়া যাবার পর থেকে মনে হইতেছে, সংসারে আমার প্রয়োজন শেষ। তোমা বিহীন এ জীবনের অর্থ খুঁজিয়া পাইতেছি না। তারপরও আশায় আশায় রহিয়াছি। জগতে তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক। ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি জগতের কল্যাণের জন্য তিনি যেন তোমাকে নিয়োগ করেন। জীবের মঙ্গলের জন্য যে কোনো কর্ম বিধাতা খুশি হোন। তুমি জন্মের পর মাতৃহীন। বেবী জননী, তোমার মাতৃরূপিনী। আমার প্রণাম তাঁকে পৌঁছাইয়া দিও। ভালো থাকিও। মনে রাখিও, জগৎ বড়োই বিচিত্র জায়গা। ইতি তোমার কাঙাল বাবা।’
উমিলার চোখে জল চলে এল।
অনেকক্ষণ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে উদাস মনে হয়। বুক ভরে কান্না আসে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেল লাইনের সমান্তরাল পথরেখা নজরে আসে। যতদূর চোখ যায় পাশাপাশি একা।
রুবী উর্মিলাকে নিয়ে অফিসে ঢোকে।
ঢুকেই দেখতে পায় রুবীর টেবিলের পাশে আরেকটি চেয়ার টেবিল।
ঢুকতেই পিয়ন বলে, ‘নতুন ম্যাডামের জন্য।’
উর্মিলা শুধু একবার রুবীর দিকে তাকায়।
দু’জনের চোখে বিস্ময়।
উর্মিলা নতুন চেয়ারে বসতেই বাবার মুখ মনে পড়ে। মাথার ভেতর জলতরঙ্গের শব্দ শুনতে পায়। অনেক শব্দ-সুর অচেনা। চোখ ছাপিয়ে জল আসে। মৌনতা নিয়ে মাথায় হাত রেখে বসে থাকে কতক্ষণ।
রুবী বলে, ‘তোর জন্য সবকিছুই সহজ।’
‘না রুবী। বাবাকে মনে পড়ছে। আমাকে নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই।’ বিষণœ কণ্ঠস্বর উর্মিলার।
‘আমারো মনে পড়ে। বীথির কথা। পিঠাপিঠি জন্ম আমাদের। ওর খুব নায়িকা হবার স্বপ্ন।’ রুবীর কণ্ঠ উদাস। এ সময় উর্মিলার খুব হাসি পায়। রুবীর বলার ভঙ্গি যেন নায়িকা হবার জন্য এ মানব জন্ম।
‘রুবী তুমি খুব সরল! আমার মতো।’
‘উর্মি তুমি আমার মতোন না। অন্যরকম।’ ওরা স্মিত হাসে।
সাড়ে নয়টার দিকে দীপু ভাই ঢোকে। ক্ষীণলয়ে হাসি দিয়ে উর্মিলা টেবিলের সামনে বসে, ‘দেবীর নতুন চেয়ারে বসতে না জানি ক্যামন আনন্দ। জীবনের প্রথম চেয়ার তো!’
উর্মিলা দীপু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘সংবাদ ভালো দেবী। এক দিনেই মাত! নাজনীন, সুমি তো রীতিমতো ফ্যান। মন্ত্র জানেন নাকি?’ দীপু ভাই বলে যাচ্ছে।
উর্মিলার এই প্রথম মনে হলো দীপু ভাই সাধারণ পুরুষ না। সবকিছু আলাদা। চাউনি ভিন্ন, কথা বলা স্যাটায়ার সমৃদ্ধ, যা কাউকে আঘাত করে না। আন্তরিক।
আর উর্মিলার প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত।
‘বসুন দেবী। ওই চেয়ার আপনার জন্য।’
দীপু ভাই তার রুমে ঢুকে যায়।
উর্মিলা দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুবী গদগদ কণ্ঠে বলে, ‘দেবীর সকল দরজা খোলা। দীপু ভাই তোর প্রতি বেশি হ্যাংলামো করে।’
উর্মিলা কথা বলে না। ও বুঝে গেছে রুবী রোমান্টিক। সাড়ে দশটার পর হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকলেন বেবী আপা আর জাকির সাহেব।
উর্মিলার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তার রুমে ঢুকে যায়। জাকির সাহেব, দীপু ভাই, নাজনীন, সুমি, মঞ্জু সাহেবকে নিয়ে একটানা মিটিং করে দুটো পর্যন্ত। সারা অফিস থমথমে হাওয়া বইতে থাকে। বেবী আপাকে এরকম উদ্বিগ্ন দেখেনি কেউ। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও শান্ত থাকার দৃঢ়তা তার রয়েছে।
সারাদিন উর্মিলার কী কাজ? শুধু পিয়ন কিছু কাগজ ধরিয়ে দিয়ে যায়। প্রায়গুলো এক লহমায় মধ্যে পড়ে ফেলে। অনেকগুলো স্পষ্ট নয়। তবে বেবী আপার স্বপ্নের পৃথিবী নির্মাণের গল্প আছে। অসম্ভব স্বপ্নতাড়িত বোধ চোখের কর্নিয়ায় ছায়া ফেলে।
বেবী আপা রুম থেকে বের হয় সাড়ে তিনটের দিকে। দীপু ভাইয়ের রুমের দিকে যায়। বের হয় মিনিট পাঁচেক পর।
উর্মিলার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর পা থর থর করে কাঁপছে।
‘তোমার বাবার চিঠি পেয়েছ। ক্যামন আছেন উনি?’
উর্মিলা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘পেয়েছি। বাবা আপনাকে প্রণাম জানিয়েছে।’
‘ঋষি মানুষ। লিখে দাও। আমিও তার কন্যার মতো। সব ঠিকঠাক হলে ঢাকায় ঘুরে যেতে।’
‘জ্বি আপা।’
বেবী আপা দরজা ঠেলে লিফটের দিকে হেঁটে যায়। উর্মিলা কোনোকিছু না বুঝেই লিফট পর্যন্ত হেঁটে যায়।
লিফট থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রুবী এ কথা সে কথা শোনাতে চায়।
উর্মিলা বলে, ‘রুবী, কোনো কিছুই ভাবতে পারছি না। বুকের ভেতর শূন্যতা বিরাজ করছে। আমি বোধহয় বেশিদিন বাঁচব না।’
রুবী হাসে।
এ সময় দীপু ভাই উর্মিলাকে ডেকে পাঠায়। নিজেকে আতঙ্কিত মনে হয়। দীপু ভাইয়ের রুমে ঢুকে অবাক হয় উর্মিলা। অসম্ভব সুন্দর পরিপাটি সবকিছু সাজানো। কম্পিউটারের স্ক্রিনজুড়ে আরব সাগরে ভাসছে মার্কিন রণতরী। সুনসান নীরবতা। কমেন্টেস লিখে দীপু ভাই উর্মিলার দিকে তাকায়। উদাস চাউনি।
‘দেবী, শেষ পর্যন্ত আপনার দায়ভার আমার ওপর। কী আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, দিবস-রজনী আমি যেন কার আশায়-আশায় থাকি।’
‘জি?’
‘না না বেবী আপা কওলা করে দেননি। বসুন।’ উর্মিলা সামনের চেয়ারে বসে।
‘আপনার মার্কশিট আর দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে এক রিকশায় বসে তেজগাঁও উইমেন্স কলেজে যেতে বলেছে। বাকি দায়িত্ব কলেজের। বেবী আপা বলে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল আপা, বেবী আপার বান্ধবী।’
টেবিলে চা চলে আসে।
‘জি।’ উর্মিলা উদাস তাকায়। ওর মনে হয় আগ্রহ নিয়ে দীপু তাই তাকিয়ে আছে।
প্রথমে দীপু ভাইয়ের মুখ জাকির সাহেব মুখ হয়ে যায়। কিন্তু ওই চোখ বলে ওরকম না। মমতা আছে।
‘আমি তো গ্রাম থেকে উঠে এসেছি। আমার অনেক কিছুর অভাব আছে।’
‘দেবী, সবাই গ্রাম থেকে নগরে আসে। আমিও মাদারীপুর থেকে এসেছি। সংসারে বাবা নেই। জন্মান্ধ বোন আছে। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভালো ছাত্র ছিলাম। ভার্সিটি শেষ করেই বেবী আপার কাছে চলে এসেছে। আপনার মতো। সংসারে মা কুন্তি কই পাবেন! বেবী আপাই মা দুর্গা।’
হঠাৎ উর্মিলা অনুভব করে ওর চোখ ছাপিয়ে জল আসছে।
‘দেবী সংসারে চোখের জলের মূল্য নিতান্ত কম। এ মাইলস টুগো বিফোর আই স্লিপ।’
‘সংসারে বাবা ছাড়া কেউ নেই।’
‘তাইলে তো আরো ভালো, পুরোটাই মানুষের জন্য।’
‘আমি কিছু বুঝতে পারি না।’
‘দরকার নেই। কলেজে ভর্তি হোন শিক্ষাই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে।’
‘খুব বেশি খারাপ মানুষের সাক্ষাৎ এ জীবনে পাইনি।’
‘সমাজে খারাপ মানুষের কম। পারবেন দেবী। শিব মহাশয় আপনার জন্য রথের লাগাম টেনে ধরবে।’
উর্মিলা খুব বিস্ময় নিয়ে বলে, ‘আপনি আমাদের এত কিছু জানলেন ক্যামনে?’
‘দেবী আপনাকে জ্ঞান দান করি, এ জনগোষ্ঠীর মানুষ সব জানে?
উর্মিলার মনে হয় দীপু ভাই আশ্চর্য রকম তরুণ। উর্মিলার মতো মেয়েদের এ মমতার প্রয়োজন আছে। (চলবে)