বৃহন্নলা
কঙ্কন সরকার
অবশেষে ক্লান্তি জড়ানো দেহে খুঁজে পেল সে বাসাটা। অনেকটা ঘরকুণো ভীতু স্বভাবের বাবুর এবারই এই শহরে প্রথম আসা। দূর সম্পর্কের খালার বাসা। একটা চাকুরী সংক্রান্ত কাজে এসেছে সে। দূর সম্পর্কের হলেও খালার আতিথিয়তায় যেন ক্লান্তি ভাবটা দূর হলো নিমেষে। খাওয়া, গল্প, কুশল বিনিময় হতে হতে বেশ রাত হলে দু একবার হাই উঠলে ঘুমাতে যায় সে। নতুন বিছানা, সারাদিন ভ্রমণের ধকল, বাসা খুঁজে না পাওয়ার উৎকণ্ঠায় যেন ঘুম আসে, আসে না অবস্থা। হঠাৎ দরজার খটখটানি শব্দ করে খালার ডাক। দরজা খুলতেই খালা প্রায় ধাক্কা দিয়ে ধমকের সুরে ঢুকে দিতে দিতে বলে, এখানেই শোও, যত্তসব... বলতে বলতে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে যান উনি। বাবু কী দাঁড়িয়ে আছে, না, নেই! সে বোধ নেই তার। মেয়ে মানুষের সাথে একই বিছানায় থাকতে হবে! ঘরে ঢুকেই বোরখা খুলে সে শুয়ে পড়ে বিছানায়। বাবু কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বড্ড সংকোচে পেয়ে বসেছে তাকে। সে যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। নড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে। অগত্যা বিছানার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চেয়ারে বসে বই হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকে বাবু। মন! সে কী বইয়ে? কিন্তু উপায়? বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। কী, ঘুইমাবেন না? তারপর হেসে বলে, আইজকের রাইতটুকু শুধু। তবে ভোরের আগেই চইলে যামো। একটানে কথাগুলো বলে সে আবারো শুয়ে পড়ল। ও হ্যা হ্যা বলে বাবু বলেÑ এই একটুÑ? কিন্তু ওর ভিতরে নতুন এক বিষয় উঁকি দেয়! তা হলো কণ্ঠটি পুরুষালি না মেয়েলি! তাইতো বই সামনে কিন্তু মন নতুন বিষয়ে...?
আবারো কিছুক্ষণ চুপচাপ। এবার সে উঠে বসল। বললÑ তাকান না আমার দিকে। তাকান! ছ্যাৎ করে উঠল বাবুর বুকের ভেতর। তার ভেতরে বলে উঠলÑ তাকান!
Ñ কী হইলো, তাকানÑ
বাবুর শরীর কাঁপছে। সাথে ঘামছেও। কী করবে ভাবতে ভাবতে তাকালো সে।
Ñ ভালো কইরে তাকান বলে হাসল সে।
Ñ আরে? এতো Ñ
কিছু বলতে না দিয়ে সে বললÑ হ, আমিই সেই। ভারী কণ্ঠে বলে সে, বড় পরিত্যক্ত বাবা-মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে, আত্মীয় স্বজনের কাছে, সমাজের কাছে। কেউ কাছে রাইখতে চায়না। পরিচয় দিতি ভয় পায়! এইড়ে চলতে পচন্দ করে সব্বাই! চোখ ছলছল হয়ে ওঠে ওর। সে আবারো বলে, জানেন, যখন আমারে এ অবস্থা বুঝতে পারে (কণ্ঠ আরো ভারী হয়ে ওঠে ওর) কাপড় দিয়ে চোখ মুছে বলেÑ বাবা-মা এইড়ে চলতি শুরু করে। কেমন কেমন আচরণ করতি থাকে। ঢোক গিলে বলে, এক রাতে আমাকে রেইখে আসে একখানে। জানেন, যেন আমাকে হাইরে ফেলি তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল! থেমে বলে, জানেন, আমার জায়গায় অন্য একজনকে দত্তক নেয়। এবং এ বাড়ি ছেইড়ে একটা অজুহাত দেইখে দূরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে কিছুদিন। কেননা, অনেকে জেইনে যাবি যে আমি নেই! আর আমিও যেন না আসি এইখানে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেÑ ওমা, একটা বেইজেছে? ঘুমান ঘুমান বলে সে আবারো শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে সে বললÑ থাইকবেন কী আমার সাথে?
কানে পড়তেই বই থেকে চোখ ওঠালো বাবু। কী বলবে ভেবে পায়না সে। ঝিমঝিম করে ওঠে ওর মাথা। সাথে শরীরটা যেন রি রি করে ওঠে। শোওয়ার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে সে বললÑ জানেন? মন মানেনা, বাবা-মা তো! তাইতো যখন দেখার জন্য মন খুউব আকুল হয়ে ওঠে তখন ছুইটে আসি। আবারো চোখ মোছে সে। মুখে হাসির ভাব আনার চেষ্টা করে বলেÑ কইলাম না ভোর হইলেই চইলে যাব। কেননা সকাল হ’লে আবার কেউ দেইখে ফেলার বিপদ! যাহোক বলে সে আবারো বললÑ জানেন? ওইখানে যাইয়ে নতুন এক সংগ্রাম। পিতা-মাতা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন ছেইড়ে নতুনকে মেনে নেওয়া! শব্দ করে হাসল সে। হাসি থেমে বলে, ওখানকার যে প্রধান তাকেই মা তাকেই বাবা বইলে মেইনে নিয়েছি। আমার মত অন্যদেরও মেইনে নিয়েছি ভাইবোন হিসাবে। এভাবে চলতে থাকে তার জীবনের কথামালা। কখনো হাসিভাবে কখনো কান্নাজড়ানো কণ্ঠে। আবার কখনো দাঁত কটমট করে বিদ্রোহী স্বরে, কখনো হতাশা আর বেদনার স্বরে...
কখন যে ঘড়ির কাঁটা তিনটা পেরিয়ে গেছে? ওতে চোখ পড়তেই ওমা বলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। বোরখা পড়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, আসি এইবার। হাসির ভাব করে বলে, আপনের ঘুম?
না, থাক্, থাক্ বলে বাবু বলে, ঘুমের চেয়েও বেশি কিছু পেয়েছি আমি! তারপর সে বলে আপনার বাবা মার সাথে দেখা করে যাবেন না? সে যেতে ধরে থমকে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কইনি, আমরা বড় পরিত্যক্ত! খানিক দম নিয়ে বলে, আমাদের পরিচয় কী, জানেন তো? প্রায় চিৎকার করে বলে ওÑ হিজড়াÑ বৃহন্নলাÑ
দরজা খুলে চলে যায় সে। স্যান্ডেলের খটখট আওয়াজের মধ্যে বলে সে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়–ন। এদিকে খালার ঘরের দরজা খোলারও শব্দ পেল সে।