উৎসর্গ কবিতাটি হেলাল হাফিজের
মোস্তফা হায়দার
আমার কবিতা দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।
কবিতা দিয়ে যাবো-মানে ? এক কঠিন বিষয়ের দিকে কবি ভাবতে বসাচ্ছেন পাঠককুলকে। কবিতা এক আশ্চর্য রসায়নের নাম। কবিতার পিঠে চড়ে ভ্রমণ করা যায় বিশ্বের আনাচে কানাচে। কবিতাকে সঙসার যাপন করে পার করে দেয়া যায় এক জীবন। কবিতার জন্য হওয়া যায় সংসার বৈরাগি। কবিতা আসলে এক দর্শনের নামও। কবিতার নিজস্বতায় একটা ঘ্রাণ ও মাদকতা আছে। কবিতা ছেঁড়া কাঁথার মতো ছিড় দিতে যানে। কবিতা জানে বিপ্লবের ডাক দিতে। কবিতাকে স্বপ্নের বাগানে ঢুকিয়ে আদায় করা যায় প্রেয়সির মাদকতা । কবিতা আপন আলোয় যখন উদ্ভাসিত হয় তখন কবি আর পাঠক হয়ে যান খোঁজে ফেরা এক জেলের মতো।
কবি হেলাল হাফিজের ভাষায়- ‘কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে’,আশ্চর্য এক ধ্যান ধারনা কবিকে পেয়ে বসেছে। কবিতাকে এমন আপন করে সেই দেখতে পারে, যে কবিতাকে নিয়ে সংসার যাপন করে। কবিতার সতরখানি টেনে ধরে কবি ভেতরে হাঁতড়াতে চান মানবের এক বৈশ্বিকছুরুতে। যে রুপে শব্দের পাঁজাকোলা গতরেঢুকে কবি দেখেন স্রষ্টার আপনতা। কবিতা এক জলে ভাসা ফেনার মাঝে ভাসতে থাকা এক ভিন্ন অনুভূতির নাম। কবিতায় কবি হেলাল হাফিজ যখন বলেন- ‘আমার কবিতা দিয়ে যাবো/ আপনাকে, তোমাকে ও তোকে’ কবি এমনভাবে যখন বলতে সাহস করেন তখন বুঝতে হবে কবি দ্রষ্টার ভুমিকায় অবর্তীণ। কবিরা সমাজের বাইরের যেমন নয় তেমনি স্বপ্নের বাইরেরও নন। কবি হেলাল হাফিজ তার উৎর্সগ কবিতাটি আমাদের সামনে তুলে ধরে বসিয়ে দিয়েছেন নতুন করে ভাবতে। আসলে কবিতার সক্ষমতা আর কবির গাঁথুনির টেকসইতায় পাঠকভক্তকুল ভাসতে থাকেন এক নতুন পৃথিবীতে। আবিস্কার করেন কবির স্বতন্ত্রতাবোধ।
কবি হেলাল হাফিজ যখন কবিতাকে বিশেষায়নে বসিয়ে পাঠকের সামনে ছেড়ে দিলেন তখন পাঠক মাত্রই ভাবতে বাধ্য । কবির উৎর্সগ কবিতাটির প্রতিটি লাইনের পরতে পরতে ভাবতে হয়। কবিতা নিয়ে কবির বিশ্বাসের জায়গা অনেক বড় । কবি কবিতাটিতে ইঙ্গিত করে করে সামনে হেঁটেছেন নিজের মতো করে। কবির ভাষায়-
কবিতাতো রুপান্তরিত শিলা, গবেষানাগারে নিয়ে
খুলে দেখো, তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী
কবির কথাগুলোতে একধরণে চিত্রল আর্কষণ আমাদের চোখে পড়ে। কবি বলতে চান মানুষ যেমন রুপান্তরের বাহন তেমনি কবিতায় জীবন রুপান্তরে শিল্পও তোমরা খোঁজে পাবে নিশ্চিত। এতোটুকুতে থেমে থাকতে পারতেন। না, তিনি আরো গভীরে ঢুকতে ইঙ্গিত করেন ইপ্সিতভাবে । কবিতাকে নিয়ে গভেষাণার রন্দ্রে প্রবেশ করতে । যেখানে পড়ে আছে বাস্তবতার এক বিষক্রিয়া অথবা নন্দনকলার এক সোনালী আভরণ। এতো ইঙ্গিতময়তায় কবি কেনো গেলেন ! কবি বুঝাতে চেয়েছেন পৃথিবীর সবলীলা ¯্রষ্টার আরেক নির্দশন। স্রষ্টার ভাষায় ‘মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত’ আর সেখানে আমরা খোঁজে পাই ইতিবাচকতার এক নিদর্শন। কবি তার বিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে বলতে সাহস করেছেন যে, কবিতায় খোঁজে পাবে মানুষের মৌলিক কাহিনী। আর্শ্চয এক রসায়নের দিকে ইঙ্গিতও বটে। একজন বিশ্বাসী কবিও বটে। কবিদের বিশ্বাসের জায়গায় অনেক সময় বেতালসময় ভর করে বসে। তখন কবিকে নিয়ে পাঠক বিভ্রান্তই হন। কবি হেলাল হাফিজ বুঝতে বাকি রাখেননি যে, মানুষের সব মৌলিক কাহিনী নিয়েই বাস্তবজীবন। এ রকম কিছু বাস্তব বিষয় আমরা দেখতে পাই নাজিম হিকমত এবং গ্রুন্টার গ্রাসের কবিতায়। তখন আস্থার জায়গাটুকু হয় অনেক প্রসারিত। এমনটা আমার মতো পাঠক মাত্রই ভাবতে পারেন। কিন্তু কবির অস্থাচলের আস্থায় মানুষের কথাই বলতে চেয়েছেন। যাপিতজীবনের কথা বলতে চেয়েছেন। ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছেন ।
যুদ্ধবিগ্রহ এবং সভ্যতার কথা বলতে গিয়েও কবি কবিতার দ্বারস্থ হতে বলতে চেয়েছেন। অন্তর্চক্ষুদিয়ে কবিতাতে খোঁজে পাওয়া যায় অনেক কিছু। ভব ও ভাবের এ দুনিয়ায় হরেক রকম লীলার র্দশনও কিন্তু কবিতা । সে কথা প্রমাণ করতেই আবার হাজির হতে হচ্ছে উৎসর্গ কবিতার কাছে। কবি হেলাল হাফিজের কাছে। কবির কবিতার ভাষায় দেখত পাই-
মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন ।
আহা ! কবিতার এতো শক্তিময়তা ! অবাক করা বিশ্ময়ে আমরা কবিতার পাঠক হতে চলেছি। একজন হেলাল হাফিজকে পাঠ করতে গিয়ে কতো কিছুইনা হাতের মুঠোয় ধরা পড়ে। কবির জীবন্ততায় শিল্প আর শিল্পের বয়নশক্তি বার বার ভাবতে বাধ্য করে। একজন কবি এতো নিপুণভাবে শৈল্পিকহাতে কিভাবে কবিতাকে করে রাখেন জীবন্ত ! কবিতাকে একসময় স্বপ্ন এবং দ্রষ্টা মনে করে আসলেও এখন কবিতাকে ভাবতে বসেছি বাস্তবতার মৌলিক কাহিনী অথবা জীবন দর্শন!
কবিতা মানুষের অন্ধের ষষ্টির মতো ভূমিকা রাখতে বাধ্য করে হেলাল হাফিজের ভাষায়। কবিতা দিক দেখানো চিহ্নের বাহন হিসেবে সমাজের মানুষের কাজ করে বলে দৃঢ়তার সহিত বলতে চেয়েছেন। এটাই যেমন কবির কবিতার বাস্তবতা তেমনি সাহসের সমাচারও বটে। একজন কবিই পারে - নোঙর তোলো তোলে , সময় যে হলো হলো, নোঙর তোলো তোলো’র মতো চেতনার দামামা বাজাতে । কবিতা এ দেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার সাথে জড়ানো আছে । কবিতার দ্রোহে স্বাধীনতার স্বাধীনগণ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গেয়েছিলেন- ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে মোরা যুদ্ধ করি ’ । এটাই কবিতার শক্তি । এটাই কবিতার পথ দেখানো। হেলাল হাফিজের ভাষায়-
কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে
নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে-
পথিক এ পথে নয়
ভালোবাসা এই পথে গেছে
কবি পথিকের ভূমিকায় কবিতাকে একান্ত নিজস্ব ইশারায় ভাবাতে চেয়েছেন । কবি চাইলে ’এ ’ বলে সম্বোধন করতে পারতেন। তা না করে কবি করেছেন ’এই ’ বলে । এখানেই কবির দ্রঢ়তা যেমন, আস্থাও তেমন। শিল্পের অনন্য সাধারণ রুপ ব্যবহার করে কবিতাকে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়াই কবির কাজ । আর তেমনটি করে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন কবি হেলাল হাফিজ ।
কবিতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসায় কবির নিজস্বতা প্রকাশ পায় । কবি আগত সময়ের অদৃশ্যমান নিশ্চিত বিষয়গুলো নিপুণতায় ভরে তুলতে চেয়েছেন কবিতায় । যদিও সেটা কবির নিজস্ববচন। কিন্তু পাঠককুল নিজেরই সম্পদ মনে করে গেঁথে রাখেন আপনালয়ে। কবির ভাষায়-
কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
তারও আছে বিরহে পুস্পিত কিছু লাল নীল ক্ষতো।
যাপিতজীবন, স্বপ্ন সোপান, দু:খ- বিরহ সব একাকার হয়ে মানুষের আষ্টেপৃষ্টে গেঁথে থাকা জীবনই কবির জীবন এবং কবিতার র্দশনও বটে। কবি কবিতাকে মানুষের সাথে সাজুয্য করে বাঁচার স্বপ্ন দেখান । বেঁচে থাকা জীবনের বয়ন করে করে কবিতাকে নিয়ে যেতে চান মানুষের বিকল্পে । যে গ্রহে মানুষ থাকবে না সে গ্রহের মানুষ কবিতাকে আপন করে বাঁচতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস । কবি হেলাল হাফিজ আপন আলোয় উদ্ভাসিত এক নক্ষত্রের নাম। এ সমাজের মানুষকে কবিতায় আচ্ছন্ন হয়ে দৃঢ়তার সহিত এগিয়ে যেতে স্বপ্ন দেখানো এক পুরুষ । কবির উৎসর্গ কবিতাটি আমাদের বার বার পাঠ করার পাশাপাশি যাপিত জীবনে মাদুলির মতো আঁকড়ে রাখার চেষ্টাও করা যেতে পারে । কবির প্রতিটি কবিতার চেয়ে উৎসর্গ কবিতায় হারিয়ে গেছি কিছুটা সময় ।