মানবিক মূল্যবোধ
মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল
মানব মনের সংকীর্ণতা অধিকাংশ সমস্যার মূল কারণ। সমাজ প্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে মানব মনে লালন করা মানবিক উদার প্রান্তরে প্রস্ফুটিত সৌন্দর্য চেতনার ওপর। আর মনুষ্যত্ব বিকাশের একমাত্র অনুষঙ্গ হলো মানব মনের ক্রমবিস্তার। সমাজ প্রগতিতে মনুষ্যত্ত্ব বিকাশের অবদান যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। অনেকেই মানবতা, মানবিকতা এবং মানবতাবাদকে অভিন্ন মনে করেন। আসলে মানবতা হলো- মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ মায়া মমতা। আর মানবিকতা হলো প্রতিটি মুহূর্তের চিন্তায়, আচারে, প্রেরণা ও কর্মে মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার ঐকান্তিক ও কার্যকর মনোভাব। অপরদিকে,
মানবতাবাদ হচ্ছে একটা পার্থিব জীবন দর্শন যা যুক্তিতর্ক, নৈতিকতা ও সুবিচারকে ধারণ করে এবং বিশেষত নৈতিকতা ও সিদ্ধান্ত প্রনয়নের ভিত্তি হিসেবে অলৌকিকতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। সাধারণ মানুষতো বটেই, বিজ্ঞজ্জনেরাও অনেক সময় মানবিকতা ও মানবতাবাদকে এক করে দেখেন। কারণ, মানুষিক চেতনার অভিন্ন বলয়ে মানবিকতা ও মানবতাবাদের মতাদর্শিক ভারকেন্দ্রে থাকায়, অনেক সময় পরস্পরাঙ্গী অঞ্চলে এই দুই বোধের জড়াজড়ি চলে। ফলে সাধারণ মানুষ বুঝে ওঠতে পারে না আসলে কোনটা দ্বারা কী বোঝায়। মানবিকতা ও মানবতাবাদের সাধারণ অন্তর্প্রবিষ্ট অঞ্চল থাকায় সহজ-সরল দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাভাবিকভাবেই মানবিকতা ও মানবতাবতাবাদকে এক করে দেখার অমসৃন পথ তৈরি হয়েছে। মানুষ সমাজে বাস করে। সামাজিক প্রাণী হিসেবে পার্থিব জীবনে মানুষের প্রতি মানুষের টান আছে, পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবণতা আছে। সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মানুষের মধ্যে যূথবদ্ধ প্রয়াস আছে। মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁক ও সমস্ত সৃষ্টিকুলের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের সহজাত প্রবৃত্তি মনুষ্যসত্তার মধ্যেই নিহিত আছে বলেই মানুষ পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে টিকে আছে। মানুষ মানুষ হতে চায়, মানুষরূপে বাঁচতে চায়। এই যে বাঁচার আকুতি, এটা একটি মানবিক আকুতি। একইভাবে মানুষ মানুষকে বাঁচাতেও চায়। এজন্য সে মানুষের বিপদে, দুর্বিপাকে এগিয়ে আসে। এটা মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক সাড়া, যাকে আমরা মানবতা বলি। সহজ অর্থে মানব জন্মের সাথে মানবতা জম্মেছে। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর বা জন্মের পর মানুষ যখন তার ইন্দ্রীয় সম্পর্কে সচেতন হয়, ইন্দ্রীয়উপাত্ত নির্ভর প্রত্যক্ষণ দ্বারা চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে শিখে, তখন সে সহজবোধ ও আগন্তুক বোধের দ্বান্ধিক বিরোধের মধ্যে পড়ে যায়। তখন সে নিশ্চয়তা চায়, নিজের অস্থিত্বের, চেতনার, সংবেদনের এবং প্রত্যক্ষণজনিত জ্ঞানের। আপাত প্রমাণের ভিত্তিতে, খ-িত স্থান-কালের প্রত্যক্ষণকে মানুষ সত্য হিসেবে ধরে নেয়। এই ধরনের একটি বিশ্বাসের জোরে মানুষ ঘোষণা করতে শুরু করে, সত্য তা-ই, যা মানুষের প্রত্যক্ষণে ধরা দেয়। মানুষের কাছে যা সত্য বলে প্রতিভাত হবে, তা-ই সত্য। ফলে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে মানবকেন্দ্রিকতার নাম দাঁড়ায় মানবতাবাদ। মানবতা মানুষের অন্তরঙ্গ হলে মানবতাবাদ হবে বহিরঙ্গ; একটি সহজ, আরেকটি আগন্তুক বা নির্মিত। এই ধরনের মানবতাবাদের একটি আদিকল্প হচ্ছে ‘ম্যান ইজ দ্য ম্যাজার অব অল থিংস’, যেটা প্রোটাগোরাসের ( খ্রি পূর্ব ৪৯০-৪২০) ঘোষণা আকারে বহুলভাবে প্রচারিত। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার৷ আমার কাছে আমার মাতৃভূমি যেমন প্রিয়, অন্যের কাছে তারও মাতৃভূমি তেমনি প্রিয় । কিন্তু আমি যদি ভেবে নিই, আমার মাতৃভূমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা, আমার মাতৃভূমি উৎকৃষ্ট, অন্য ভূমিগুলি নিকৃষ্ট । অন্য ভূমিকে শোষণ করে আমার মাতৃভূমিকে পুষ্ট করব। তাহলে তো তা যুক্তিপূর্ণ হল না। ওই ভূমিটিও যার মাতৃভূমি সেও যদি তাই ভাবে, তাহলে এই দুই এলাকার মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধবে । সহযোগিতার বদলে একে অন্যের সর্বনাশ চাইবে । তাতে তো বৃহত্তর সমাজের উন্নতি ও শান্তি-উভয়ই ব্যাহত হবেএই যে একটা বিশেষ ভূমির জন্যে বিশেষ ভাবাবেগ বা সেন্টিমেন্ট, এর নাম ভৌম ভাবাবেগ বা জিও-সেন্টিমেন্ট । এই জিও-সেন্টিমেন্ট মানুষের মনের বিস্তারকে একটা সীমিত গ-ির মধ্যে আটকে রাখতে চায়, মনের গতিকে রুদ্ধ করে দিতে চায় । নদীর গতি যদি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয় সেই বদ্ধ জলাশয়ের জলে পচন ধরে। তা অস্বাস্থ্যকর। তাই জিও সেন্টিমেন্টও মানবসমাজের বৃহত্তর কল্যাণের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
জিও-সেন্টিমেন্ট থেকে জন্ম নেয় জিও-পলিটিক্স, জিও-ইকনমিক্স, জিও-রিলিজিয়ন প্রভৃতি। অন্যের এলাকা আক্রমণ করে আমি আমার দেশের সীমানা বাড়াব। এরই নাম হোল সাম্রাজ্যবাদ। এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শাসকগোষ্ঠী একসময় গোটা পৃথিবীতে তাদের সা¤্রাজ্য বিস্তার করে অন্যান্য দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল ও যথেচ্ছভাবে শোষণ করেছিল। হিটলারও এই করতে চেয়েছিল। একে কেন্দ্র করেই তো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেল- লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহাণি হয় । তাই আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা পেছনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আর কোনো জিও-সেন্টিমেন্টকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না । বৈশ্বিকতাবাদকেই আজকের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে ।
মাতৃভূমির উন্নতির জন্যে আদর্শ হবে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা। যে যার অঞ্চলের সর্বাত্মক বিকাশ ঘটাতে ও তার নিজ নিজ অঞ্চলকে সমস্ত প্রকার শোষণ থেকে মুক্ত করতে অবশ্যই চেষ্টাশীল হবে । সমস্ত অঞ্চলকে নিয়ে পৃথিবী । বিভিন্ন অঞ্চল যদি উন্নত ও শোষণমুক্ত না হয় তাহলে বিশ্বশান্তি কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷
আমার স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আমি অন্যের ওপর অন্যায় করতে পারি না । অনেক ফুল নিয়ে একটি মালা তৈরি হয়৷ ফুলগুলি সুন্দর না হলে মালাখানি কখনো সুন্দর হবে না।মালার সৌন্দর্য ফুলের সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নতিকে উপেক্ষা করে বিশ্বের উন্নতি হতে পারে না । জিও-রিলিজিয়নও সমর্থনীয় নয়। রিলিজিয়ন তো ঈশ্বর সম্পর্কীয় ব্যাপার৷ ঈশ্বর সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা, সমগ্র বিশ্বের পালক আরও কত কী! তাই এক এক স্থানের জন্যে পৃথক পৃথক ঈশ্বরের ধারণাও মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়৷ জিও-রিলিজিয়নকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সমাজে নানা কুসংস্ককার ও অন্ধবিশ্বাস রয়েছে কোনো বিশেষ দেশের নদীর জল একমাত্র পবিত্র , আর অন্য দেশের নদীর জল অপবিত্র- এই ধারণা কেবল কুসংস্কার থেকেই জন্ম নিতে পারে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান । সর্বত্র বিরাজিত এই অনন্ত ঈশ্বরকে নিয়ে খ- খ- ভাবনা ভিত্তিক অন্ধবিশ্বাসকেও তাই মানা যায় না৷
ভৌম ভাবাবেগ বা জিও-সেন্টিমেন্ট যেমন বিশেষ ভূমিকে কেন্দ্র করে অযৌক্তিক সেন্টিমেন্ট, তেমনি কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে কোনও অযৌক্তিক সেন্টিমেন্টকে (সোসিও-সেন্টিমেন্ট) প্রশ্রয় দিয়ে ও অবশিষ্ট মানব সমাজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া মোটেই সমর্থনীয় নয় । ইতিহাস সাক্ষী, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ভাবাবেগকে (সোসিও সেন্টিমেন্ট) ভিত্তি করে ইতোপূর্বে জাতপাতের লড়াই, জাতিদাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে বহু রক্তস্রোত বয়ে গেছে। শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার তাই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য। তিনি বলেছেন, ‘পরমপুরুষ আমার পিতা, পরমা প্রকৃতি আমার মাতা, আর ত্রিভূবন আমার স্বদেশ । আমরা সবাই বিশ্বনাগরিক’। এটাই সবার আদর্শ হওয়া উচিত । তাই ভৌম ভাবাবেগ বা জিও সেন্টিমেন্ট-এর মতো ‘গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ভাবাবেগ বা সোসিও সেন্টিমেন্ট’ মানব সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের ও বিশ্বশান্তির অন্তরায়। বর্তমানে মানবতাকে তথা মানবতাবাদভিত্তিক আন্তর্জাতিকতাবাদকে মানব সমাজের পক্ষে কল্যাণকর সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে । কিন্তু মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার দেখিয়েছেন, এই মানবতাবাদও ত্রুটিপূর্ণ । কারণ, প্রথমত এই মানবতাবাদের পেছনে কোনো অফুরন্ত প্রেরণার উৎস নেই। তাই এই মানবতাবাদ যতটা লোক দেখানো ততটা আন্তরিক নয়। দেখা যায়, মুখে মানবতার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ভেতরে আত্মস্বার্থের ভাবনা টনটনে। সুযোগ পেলেই ভেতরে সংকীর্ণ ভাবনার বহিঃপ্রকাশও ঘটে। বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখি মুখে বিশ্বশান্তির কথা, নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ভেতরে নিজেদের অস্ত্রভা-ার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তথাকথিত মানবতাবাদের দ্বিতীয় ত্রুটি হচ্ছে, এতে সমস্ত মানুষের স্বার্থের কথা হয়তো ভাবা হচ্ছে, কিন্তু এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জীব রয়েছে, পশুপক্ষী-তরুলতা রয়েছে, তাদের কথা ভাবা হচ্ছে না। মানুষ তার স্বার্থে যে যথেচ্ছভাবে পশুপক্ষী হত্যা করছে, বনজঙ্গল ধবংস করছে, তার ফলে বিশ্ব সমাজের ভারসাম্য নষ্ট-হচ্ছে, বিশ্ব পরিবেশ দূষিত হচ্ছে- এর প্রতিকারের কথা ভাবা হচ্ছে না। মানবতাবাদ কেবল মানুষকে ভালবাসার কথা বলছে, কিন্তু-মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীবকে ভালবাসার কথা বলছে না--- এটাই মানবতাবাদের মূলগত ত্রুটি। কিন্তু মানব ভূবন যে মানবময় তা স্বীকারে কেউ দ্বিমত পোষণ না করলে বিশ্বব্রহ্মা-ের সর্বজীবে সর্বসত্তায় পরিব্যপ্ত ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত হওয়ার আকুতি আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এজন্যে চাই, ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার নিত্যাভ্যাস। আর এই আধ্যাত্মিক নিত্যাভ্যাসই মানুষের মনে বিশ্বব্রহ্মা-ের সর্বসত্তার প্রতি আন্তরিক ভালবাসা জাগিয়ে তুলবে ও ধীরে ধীরে অন্তর থেকে বিশ্বের সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী, তরুলতার প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ জেগে উঠবে।