বেদনার জলরঙ





বেদনার জলরঙ
ইসলাম তরিক

- কইরে নান্টু? কই গেলি? তাড়াতাড়ি পানির বালতিটা ভরে নিয়ে আয়।
- এইতো চাচি আসছি। একটু অপেক্ষ করেন।
- তাড়াতাড়ি কররে বাবা। চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে।

নান্টু তাড়াহুড়ো করে পানির বালতিটা ভরে নিয়ে এসে হাঁপাতে লাগল। নাদুস-নুদুস শরীরের অধিকারী নান্টুর হাঁপানো দেখে আছিয়া বেগম হাসতে হাসতে বললেন এটুকুতেই হাঁপিয়ে উঠলি?
- আর বলবেন না চাচি। খাবার অনেক কমিয়ে দিয়েছি। তারপরেও শরীরটা কমছে না।
- থাক কমানোর দরকার নেই। এই শরীরে তোকে মন্দ লাগছে না।
- সত্যি বলছেন চাচি?
- হ্যাঁ।
- কিন্তু আমার এই শরীর দেখে অনেকে হাসাহাসি করে।
নান্টুর কথা শুনে আছিয়া বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে আবার হাসতে লাগলেন।
- চাচি আমার কথা শুনে আপনি হাসছেন কেন?
আছিয়া বেগম আর কথা বাড়ালেন না। তিনি আপন মনে ফুলগাছে পানি দিতে লাগলেন।

পুকুরপাড়ে তিন-চার শতাংশ জমির ওপড়ে সুন্দর একটি ফুলের বাগান করেছেন আছিয়া বেগম। অনেক ফুলের গাছ আছে এই বাগানে। কোনো কোনো ফুল সারাবছরই ফোটে। আবার কিছু ফুলের চারা সিজনাল। সিজন ছাড়া সেগুলোতে ফুল ফোটে না। ফুলবাগানের চারপাশে এবং পুকুরপাড়ের সমস্ত জায়গাজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ফলের গাছ। সেই গাছগুলো থেকে ফর্মালিন মুক্ত মৌসুমি ফল পান আছিয়া বেগম। কোনো ফলই বিক্রি করেন না তিনি। ফলগুলো নিজেরা খান এবং পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিলিয়ে দেন । এই বাগানটি আছিয়া বেগমের নিজের গড়া। দিনের পর দিন শ্রম দিয়ে তিনি এই বাগানটি তৈরি করেছেন।

পেশায় তিনি স্কুল শিক্ষিকা। সকালে সংসারের কাজ থাকে। তাই সকালে তিনি বাগানে সময় দিতে পারেন না। খুব বড় সংসার তাঁর। আবাদি জমি রয়েছে ৫০ বিঘা। সবগুলো জমি নিজেরা চাষ না করলেও সংসারের ঝামেলাটা নেহাৎ কম নয়। তবুও তিনি প্রতিদিন বিকালে একটু করে সময় ব্যয় করেন বাগানে। বাগানটি প্রথমে শখের বশে করলেও ইদানিং কিছুটা মানসিক যন্ত্রনা লাঘব করে এই বাগানটি। তিনি আসলাম সাহেবের ৪র্থ স্ত্রী। আসলাম সাহেব এলাকার মাতবর। অন্যের বিচার-শালিস করে দিন পার করে। আগের তিন স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পরে তিনি আছিয়া বেগমকে বিয়ে করেন। আছিয়া বেগম এরকম একটি মানুষকে স্বামী হিসেবে কখনই বুকে লালন করেননি। কিন্তু ভাগ্যের লিখন যায় না খ-ন! শেষ পর্যন্ত সম্পদের লোভে আছিয়া বেগমের বাবা আছিয়া বেগমকে আসলাম সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছেন।

আসলাম সাহেব অদ্ভুদ চরিত্রের মানুষ। এক নারীতে তিনি কখনোই তৃপ্ত থাকতে পারেন না। ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি অন্য নারীর সঙ্গে গড়ে তোলেন শারীরিক সম্পর্ক। মন্দা এলাকায় আর্শিন-কার্তিক মাসে যখন গরিবের ঘরে খাবারের চাল থাকে না, তখন অভাবীদের অভাবের সুযোগ নিয়ে তিনি কুকর্মের প্রস্তাব দেন। অভাবের তাড়নায় গ্রামের কিছু নারীরা তাঁর প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। এভাবে অভাবের সুযোগ নিয়ে তিনি বহু নারীর সর্বনাশ করেছেন। বিয়ের দু-এক বছরের মধ্যে আছিয়া বেগম তা বুঝতে পারেননি। পরে তিনি বুঝতে পারলেন কেন আগের তিন স্ত্রীকে তিনি তালাক দিয়েছেন। আসলাম সাহেবের এসব কুকীর্তি যখনই আছিয়া বেগমের নজরে পড়ে, তখনই তিনি প্রতিবাদ করেন । কিন্তু কোনো লাভ হয় না। যখনই তিনি এসব কুকীর্তর প্রতিবাদ করেছেন, তখনি আসলাম সাহেব আছিয়া বেগমকে তালাকের হুমকি দিয়েছেন। স্বামীর মুখে তালাকের কথা শুনে আছিয়া বেগমের নারী হৃদয় আঁৎকে উঠে। হারিয়ে যায় প্রতিবাদের সুর। সন্তানের কথা ভেবে, নিজের আত্মমর্যাদার কথা ভেবে, আছিয়া বেগম নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন আসলাম সাহেবের কুকীর্তিগুলো। স্বামীর কুকীর্তিগুলো দেখে তাঁর বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কিন্তু কিছুই করতে পারেন না তিনি।

কষ্টের পরিমাণ বেশি হলেই তিনি এই বাগানে ছুটে আসেন। এখানে এলেই তাঁর মনটা ভালো হয়ে যায়। নীরব দৃষ্টিতে তিনি ফুলের দিকে তাকান। ফুলে মৌমাছি পড়ে। তিনি খুব সূক্ষভাবে মৌমাছির কার্যাদি লক্ষ্য করেন। কখনো গাছের দিকে তাকান। গাছে অসংখ্য পাখি আসে। তিনি পাখিদের গান শুনেন। আপন মনে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সময় পেলে তিনি পাখিদের খাবার দেন। খাবার খেয়ে পাখিরা নাচানিচি করে। কখনো-সখনো পাখিদের সঙ্গে তিনি গানও ধরেন। কষ্টের কথাগুলো তিনি পাখিদের শোনান। তাতে তাঁর মনটা হালকা হয়ে যায়।

নান্টুকে সঙ্গে নিয়ে আজ আছিয়া বেগম তাড়াহুড়ো করে ফুলগাছে পানি দিয়ে বাড়িতে আসেন। বাড়িতে এসেই চোখে পড়ে বিব্রতকর এক দৃশ্য। স্বামী আসলাম সাহেবের আড্ডঘর থেকে এই সন্ধ্যায় সোহাগের অল্প বয়সী বউ, গায়ের শাড়ি ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসছে। আসিয়া বেগমকে বাড়ির মেইন গেটে দেখে মহিলাটি দ্রুত পালিয়ে গেল। কিছু বুঝতে আর বাকি রইল না আছিয়া বেগমের। বিতৃষ্ণায় মনটা ভরে ওঠল তাঁর। তিনি কিছুটা উত্তজিত হয়েই আসলাম সাহেবকে বললেন,
- এই বুড়ো বয়সে তোমার লজ্জা করে না এসব করতে? দুদিন পরে তো কবরে যেতে হবে। সেই হুশ কী  তোমার আছে? তাছাড়া ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। নাতি-নাতনি হয়েছে। আর কত?

আছিয়া বেগমের কথা শেষ না হতেই আসলাস সাহেব কুকুরের মতো গর্জে ওঠলেন।
অকথ্য ভাষায় আছিয়া বেগমকে গালি-গালাজ করলেন। আজও আছিয়া বেগমকে তালাকের হুমকি দিলেন।

আছিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে আবার বাগানে ছুটে এলেন। এই সন্ধ্যায় গাছে অসংখ্য পাখি চিকিরমিচির করে ডাকছে। কিন্তু পাখির কিচিরমিচির শব্দ আজ ভালো লাগছে না আছিয়া বেগমের। পাখিগুলো যেন কিচিরমিচির সুরে তাঁর স্বামীর কুকীর্তির কথাগুলোই বলছে। তিনি কানে আঙুল দিয়ে পুকুরের পূর্বপাশে গেলেন। পুকুরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল গোধূলির চরম দৃশ্য। পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের লাল আলো পুকুরের পানিতে পড়েছে। মৃদ ঢেউয়ে পুকুরের পানি নড়ছে, আর চিকচিক করছে সূর্যের লাল আলো। আছিয়া বেগম অপলক দৃষ্টিতে পুকুরে পড়া সূর্যের লাল আলোর দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের কথা ভাবছেন। সূর্যের লাল আলোর সঙ্গে তাঁর জীবনের বড্ড মিল। সকালের হলুদাভাব তেজী সূর্যটা যেমন দিন শেষে পড়ন্ত বিকালে, বিদায়লগ্নে দুঃখ-শোকে লাল হয়ে গিয়েছে, তেমনি আসলাম সাহেব আছিয়া বেগমের মধুময় যৌবন শুষে নিয়ে এই পড়ন্ত বেলায় তাঁকে বিদায় করতে চাচ্ছে। আছিয়া বেগম এখন কী করবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে তিনি এতটা বৎসর সংসার করে এসেছেন। এই বৃদ্ধা বয়সে এসেও লস্পট স্বামীর কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে তালাকের হুমকি। আছিয়া বেগমের চোখ দিয়ে বেদনাশ্রু ঝরছে। বুকের ভেতর গুমরে ওঠছে কষ্টের আর্তনাদ।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট