বিরতির ঘণ্টা
আরিফুর রহমান
একটা রিকশা এসে থামল মাস্টার বাড়ির বাইরের আঙিনায়।
রিকশা থেকে নেমে এগুতেই আনুকে সবার আগে ছুঁয়ে ফেলল মাচার বাইরে ঝুলে পড়া কচি-কচি সবুজ লাউয়ের ডগাগুলি।
তখন শেষ বিকেলের সূর্যের তির্যক আভায় আকাশের টুকরো টুকরো মেঘগুলো সবে লাল হতে শুরু করেছে। মাটির দিকে নুয়ে দু’টো হাত সামনের দিকে ঝুলিয়ে ধান ক্ষেতের আগাছা টানছিল তপু। হাতের মুঠো ভরে যাওয়ায় সোজা না হয়েই ডান হাতে আগাছা, ঘাস নিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে পুকুর পাড়ের দিতে ছুঁড়ে ফেলেই সে দেখল আনু বাড়ির ভেতরে চলে গেল। তপু সোজা হয়ে দাঁড়াল। বেশ খানিকটা দূর থেকে হলেও এক পলক দেখেই সে আনুকে চিনতে পেরেছে।
খুব চেনা, সামান্য লম্বাটে একটা মুখ।
মায়াময়, নিষ্পাপ একটা মুখ।
ঝরনার মত ঝুর ঝুর খুশি ঝরে যার হাসিতে তাকে এক পলক দেখেই চেনা যায়। তপুও এক পলক দেখেই আনুকে চিনতে পেরেছে। ওর মুখের রঙ পাল্টে গেছে। ওর মুখের এই রঙ দু’জন মানুষ চেনে। একজন কাছেই কাজে ব্যস্ত ছিল। বেলা পড়ে গেছে, কিছু কাজ এখনো বাকি! কাজ ফেলে তপুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তপুর মুখের রঙ বদলে গেছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখা গেল মাস্টার বাড়ির বাইরের আঙিনা পেরিয়ে একটা রিকশা চলে যাচ্ছে।
“মতি কাহা, আমি বাড়িতে গেলাম।”
“যা বাবা যা। তোর চাচি কইলে একটু বাজারো যাইস্। আমি এটুক শ্যাষ করে আসি।”
“ঠিক আছে কাহা যামুনি।”
উরু সমান সবুজ-সবুজ সারি সারি ধান গাছ পেরিয়ে মাস্টার বাড়ির পুকুর পাড়ে উঠল তপু। পুকুরে নেমে হাতে পায়ে লেগে থাকা কাদা ধুয়ে বাড়ি ফিরবে সে।
মতি মিয়ার পাশে আগাছা টানছিল আরও দু’জন। তাদের একজন স্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে উঠল। মতি মিয়া ধান গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখল তাকে। ধমকের সুরে বলল, “জলিমদ্দি, তপুর বাহি কাম আমি করমু। তর কি অ্যাঁ, তর কি? বেআক্কল।” জলিমদ্দি থতমত খেল, “সে কতা কই নাই কাহা। কামলা দিয়ে এমুন করলে গিরস্তে আর অরে কামলা নিব?”
“চুপ থাক। খালি বেশি কতা কয়।” জলিমুদ্দির পাশে পালা ধরেছে মনু মিয়া। সে এমনিতেই কানে কম শুনে, তার উপর আবার হাতে-পায়ে লেগে ধান গাছে খস্ খস্ শব্দ হচ্ছে। মতি মিয়ার শেষ কথা তার কানেও কিছুটা পৌঁছল, মাথা তুলে কোমর সোজা করে তাই সে বলল, “কি কইলা মতি ভাই?”
“তরে কিছু কই নাই, বয়রা। তুই কাম কর।” বয়রা মনু মিয়া মতি মিয়ার কথা কিছুই শুনেনি। শেষ বিকেলের এক ঝাঁক দমকা বাতাস লাগছিল তার চোখে মুখে। সে শুধু শুনল বাতাসের হু হু। বোকার মতো চেয়ে থাকল মতি মিয়ার মুখের দিকে। মতি মিয়া হাত ভরা কর্দমাক্ত আগাছা, ঘাস পুকুর পাড়ের দিকে ছুঁড়ে ফেলে ফের নুয়ে পড়ল ধান গাছের ভেতর দিয়ে মাটির দিকে। মনু মিয়াও উবু হয়ে কাদার ভেতরে হাত চালিয়ে দিল।
মাস্টার বাড়ির বাইরের আঙিনার অংশটুকু তপু পা চালিয়েই এসেছে। উত্তর দিকের ঘরের জানালা খোলা। জানালার সামনে লাউ গাছের মাচা থাকায় ঘরের ভেতর থেকে কোন পথিকের মুুখ স্পষ্ট দেখা যায় না, তবুও তপু পা চালিয়ে দ্রুত চলে এসেছে। অস্বস্তিতে।
আনু প্রায় দেড় বছর পর গ্রামে এল। শহরে বড় ভাইজানের বাসায় থেকে লেখাপড়া করে। বি,এড করছে। পাস করে বেরুলেই আগ পাড়ায় যে নতুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের কথা হচ্ছে তার শিক্ষিকা হবে। তপু চলতে চলতে ভাবছে, মাথার উপরে বাবার ছায়া থাকলে সেও নিশ্চয়ই বি.এড করতে পারত। পাস করে মাস্টার হতো। ছোটবেলায় সে আর আনু একই ক্লাসে পড়ত। ক্লাস ওয়ান থেকে এইট পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় আনু প্রথম হতো আর সে হতো দ্বিতীয়। প্রাইমারী বৃত্তি পেয়েছিল দু’জনেই। জুনিয়র বৃত্তিও নিশ্চয়ই দু’জন এক সাথেই পেত। কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষার মাত্র ক’দিন আগে বার্ষিক পরীক্ষার একটি বাকি থাকতেই মাথার উপর থেকে তার মুক্তিযোদ্ধা পিতার ছায়া মিলিয়ে গেল। সব তছনছ হয়ে গেল। অসুস্থ থাকায় বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারল না। বার্ষিকের শেষ পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় চতুর্থ হয়ে নবম শ্রেণীতে উঠল। বাবার বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের বোঝা কাঁধে চাপল। পাঁচটি মুখের দু’বেলা খাবার জোটাতে গিয়ে ধুলোয় মিশে গেছে তার সকল স্বপ্ন!
তপুর বুকের খুব গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে এল।
উঠোনে পা দিয়েই দেখল লাভলী ভাত রাঁধছে। তপুর স্ত্রী। পায়ের শব্দে চমকে উঠে পিছনে তাকাল।
ঘোমটার বাইরে ছোট্ট একটি মুখ। উজ্জ্বল শ্যাম বরণ।
চোখ দু’টো মায়ামায়া, হালকা, পাতলা শরীর। ডাক নাম কুপি।
তপু একটা নাম দিয়েছে, চালভাজা! সে খুব ভালোবাসে বউকে। কখনো কড়া কথা বলতে পারে না। বলতে গেলেই মনে হয় এই বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। আর বলা হয় না।
ভীত এই মেয়েটিই সংসারের কাজ-কর্মে দারুণ চটপটে। স্বামীর সেবা, শ^াশুড়ীর সেবা, সংসারের যাবতীয় কাজ একা হাতে পাকা গিন্নীর মতো গুছিয়ে করে। চঞ্চলা হরিণীর মতো তার পদচারণা এ বাড়ির প্রতিটি কোণে সারাদিন। সে স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধিমতী। তপুর কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, “আনু আপা আইচ্চে শুইনছো?”
“হুঁ।”
“কার কাছে শুইনলা?”
“কারো কাছে শুনি নাই নিজ চক্ষে দেখছি।” চুলার আগুন উপরে উঠে গেছে দেখে কুপি নামিয়ে দিতে গেল। তপু ঘরে ঢুকে দেখল তার মা ঘরে নেই। “কুপি, মা কই?”
“আম্মা চাচীর সাতে গপপো করে। ডাকমু?”
“না-না। এহন বাজারো যামু, কি কি লাগবো কও।”
“কেরোসিন নাই।... আইজ কয় ট্যাহার ছোড মাছ আনবা?”
“আইজ না। কাল হাট আছে। কাল আনমু।”
“ঠিক আছে। এই নেও বোতল। কেরোসিন আর আম্মার লাইগা পান আইনো।”
তপু ঘর থেকে বেরুতেই বাড়ির বাইরে টুনির গলা শুনা গেল। “ভাবী, ভাবী, ও ভাবী। আনু আপা......”
উঠোনে পা দিয়ে তপুকে দেখে চুপ হয়ে গেল টুনি। কথা শেষ করল না।
“টুনটুনি।” টুনি নিশ্চুপ।
“সারাদিন খালি ফুড়–ৎ ফুড়–ৎ এ বাড়ি ওবাড়ি। আর বাড়িত আইসে ভাবী, ভাবী, ও ভাবী। কই আমাকে তো অমন করে ডাকস্ না!”
টুনি ফিক করে হেসে কুপির কাছে সরে গেল। কুপি টুনির কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল, “আর কহনো আমাক অমন করে ডাকবি না টুনি। তোর ভাইজান হিংসেয় জ¦লে যায়।”
তিনজন এক সাথে শব্দ করে হেসে উঠল।
বোতলটা হাতে নিয়ে তপু বাজারের দিকে চলল।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে থালা-বাসন, কাজ-কর্ম গুছিয়ে, বেশ রাতে শুতে গেল কুপি। তপু চুপচাপ শুয়ে আছে। চোখে ঘুম নেই। বাইরে উথাল-পাথাল জোছনা। কী চমৎকার আলো! খোলা জানালা দিয়ে সে আলোর আভা এসে চোখে-মুখে লাগছে। একটানা ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে তারস্বরে। তপুর মনে উথাল-পাথাল ভাবনা। পাশ ফিরে সে কুপির মুখোমুখি হল। কুপি মৃদু স্বরে বলল, “চুপচাপ ক্যান?”
“এমনেই।”
“তুমি বাজারো যাওয়নের পরেই আনু আপা আইচ্চিল।”
“বইসতে দিছিলা?”
“হ, অনেকক্ষণ গপগো কইরছে। আম্মা মাগরিবের নামাজ পড়ে বাইরে আসার পর তার শরীরের খবর নিয়ে চইলা গেছে। টুনি সাতে যায়ে থুয়ে আইচ্ছে।”
“তাই? তা তোমার সাতে বিশেষ কি কি গপপো কইরল?”
কুপি স্বামীর বুকে আঙুল দিয়ে হালকা গুতো মেরে বলল, “বিশেষ গপপো মানে কি অ্যাঁ? আনু আপা কত্তো সুন্দর করে কতা কয়। য্যান রূপকতার রাজকইন্যা গপপো করতাছে। যেমন দেকতে সুন্দর ......” তপু বউকে কথা শেষ করতে দিল না। ঠোট উল্টিয়ে বলল, “অমন সুন্দর গপপো আমিও কইতে পারি।”
“একটু শোনান দেহি মিয়া সাব।”
“তাইলে কইতাছি একটা সুন্দর গপপো শোন।
তপু নিচু স্বরে সামান্য কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিল।
“খুব দূরে একটা গ্রামের এক প্রান্তে একটা ছোট্ট নদী। নদীর দুই তীরে কেবল সবুজ-সবুজ ধান ক্ষেত। ঝিরি ঝিরি বাতাসে সবুজ মাঠ দোলে। টেউয়ের পর ঢেউ উঠে আর ভেঙে পড়ে মাঠে। যেন সবুজের সমুদ্র। তার মাঝে ছোট্ট দ্বীপের মতো একটা কুঁড়ে ঘর। রূপালি জোছনায় সে ঘরের চাল চিক্ চিক্ করে। সকাল আর শেষ বিকেলের সূর্য তারে রাঙায়।
সেই ঘরের চালের ফোঁকরে বাস করে এক জোড়া চড়–ই পাখি। একটা ছেলে চড়–ই, অন্যটা মেয়ে চড়–ই। খুব সুখের সংসার তাদের। স্বপ্নের মতো কাটে তাদের দিন-রাত।
সেই ঘরের কাছেই একটা পেয়ারা গাছ। সেই পেয়ারা গাছে মাঝে মাঝে একটা কোকিল, না-না একটা কোকিলা ক্লান্তি ঘুচাতে এসে বসে। ভারী মিষ্টি সেই কোকিলার কণ্ঠস্বর।.........
“থাইক থাইক। এত সুকের গপপো শুনে আমার শরীল কাঁইপতেছে।”
“কেন কেন গল্পটা সুন্দর না? তোমার ভালো লাগেনি?”
“সুন্দর খুউব সুন্দর। আর নিজেগো সুকের কতা শুইনতে কাগো না ভালা নাগে!”
অন্যরকম একটা ভালো লাগায় ভরে গেল তপুর বুক। সে আরেকটু কুপির কাছাকাছি হয়ে বলল, “আমার চালভাজার খুউব বুদ্ধি।”
ছলকে উঠল তপুর স্ত্রী লাভলী পারভীন কুপি। স্বামীকে মিষ্টি একটা শাস্তি দেবে সে। কিন্তু তার আগেই বাড়ির বাইরের আঙিনার উত্তর দিক থেকে ভেসে এল মতি মিয়ার গান।
“হায়রে অবুঝ নদীর দুই কিনার
না যায় দূরে না পায় কাছে মুখোমুখি বসে আছে
অন্তর দুইজনার।”
তপু অবাক হয়ে গেল, “মতি কাহা এহনো ঘুমায় নাই!”
খোলা জানালায় কাছে মুখ নিয়ে সে উচু গলায় ডাকল, “ও কাহা, এত রাইতেও বাইরে যে, ঘুমাও না?”
“ঘুম আসে না বাজান। এত ফক্ ফকা জোছনা। ধানগাছ গুলে কী যে সুন্দর নাগে!”
তপুর উচু গলা কানে যেতেই ঘুম থেকে চমকে উঠেছেন তপুর মা। এ অসুখটা ছিল তপুর বাবার। যুদ্ধের পর থেকেই রাতে সামান্য শব্দ হলেই তিনি ঘুম থেকে চমকে উঠতেন।
তারপর মাঝে মাঝে বাতি জ¦ালিয়ে সারা ঘর ঘুরে দেখতেন। মাঝে মাঝে ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখ কিছুক্ষণ নিরবে চেয়ে চেয়ে দেখতেন। পরে বাতি নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়তেন।
এভাবেই ঘুমে-জাগরণে কেটেছে অনেক অনেকগুলো রাত। তপুর বাবার মৃত্যুর পর তপুর মাকে ধরেছে অসুখটা। একটু জোরে শব্দ হলেই তিনি চমকে উঠেন।
“ক্যারা? ক্যারা রে তপু?
“কেউ না মা। মতি কাহা বাইরে বারাইছে। তুমি ঘুমাও।”
মতি মিয়ার গান থেমে গেছে। চারদিকে সুনশান নীরবতা। কেবল গাছে গাছে রাত জাগা পাখিদের মৃদু খস্ খস্ ফিস্ ফিস্ শব্দ। আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ক্রন্দন ছাড়া আর সব চুপ।
সকালের রাঙা সূর্যটা হেসে হেসে উঠছে।
নিজের ধানক্ষেতের চিকন আল ধরে হাঁটছে তপু। এক বিঘা জমি নিয়েছে সে জমির মন্ডলের কাছ থেকে। সার-বিষ আধা আধি, পুরো পরিশ্রম তপুর। ফসল ভাগাভাগি হবে আধা আধি।
ধানগাছগুলি ডাগর হয়ে উঠেছে। ঝির ঝির বাতাসে চিরল সবুজ পাতায় লাগছে দোল। তপু কতগুলি ধানগাছ টেনে নিল বুকের কাছে। হালকা কিন্তু মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগে। শিষ ফুটতে শুরু করেছে। আর মাত্র ক’ঘণ্টা দিন। এই সাদা শিষ বড় হতে হতে একসময় ঝুলে পড়বে। সাদা থেকে সবুজ হবে। ভেতরে দুধের মতো সাদা রস জমে চাল হবে। তারপর সবুজ পাতাগুলো আস্তে আস্তে হলুদ হবে। আর কাঁচা সবুজ ধানগুলো পেকে হবে সোনালি। তপুর চোখে-মুখে সকালের সূর্যের রক্তিম আভা ছাপিয়ে জোছনার চকচকে রূপ ফুটে উঠল।
আনু প্রায় দেড় বছর পর কয়েক দিন আগে গ্রামে এসেছে।
দেড় বছরে অনেকগুলো দিন। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে তপুর জীবন ধারায়। ওদের জীবন ধারণের মান আরো নিচে নেমে গেছে। মায়ের চিকিৎসা, ঝড়ে পড়ে যাওয়া ঘর নতুন করে গড়া, দ্বিতীয় বোন সুখীকে বিয়ে দেয়া ইত্যাদিতে খরচ করতে বেশ কিছু ঋণ হয়ে গিয়েছিল। ঋণ শোধ করতে চলে গেছে তপুর বাবার রেখে যাওয়া শেষ এক টুকরো জমিও। চারটি মুখের খাবার জোটাতে শেষ পর্যন্ত সে হয়ে গেছে একজন দিন মজুর।
এখন ওর চোখে ছোট ছোট স্বপ্ন।
তিনটি মুখের হাসি।
বেলা শেষে হাতে আধা সের চাল আর দু’চারটা ছোট নোট।
দু’বেলা ডাল-ভাত। কিন্তু তাতেও টানাপোড়েনের শেষ নেই। এরই মধ্যে মাস্টার বাড়ি থেকে কর্জ করতে হয়েছে এক মণ ধান। ক্ষেতের ধান পাকতে এখনো কিছুদিন বাকি। যদিও মাস্টার বাড়ির সদর দরজা তার জন্য সব সময়ই খোলা থাকে। কিন্তু আর কত চেয়ে-চিমটে নেয়া!
ধান কাটার পর ভাগাভাগি শেষে তপু যা পাবে কর্জ শোধ করে তাতে খুব বেশিদিন সংসার ভাল মত চলবে না। নিরন্তর টানাপোড়নে কিছু দিনের জন্য বিরতির ঘন্টা বাজবে। এই যা। তারপর আবার অভাবের সাথে লড়াই।
তপুর বুকের খুব গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে এল।
আনুর বাবা আবদুল মজিদ মাস্টারের মুখ থেকে কথাটা শুনে চমকে উঠল তপু। সারা শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। দ্রুত মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। তার বাবার স্বপ্ন পূরণের এমন একটা পথ তৈরি হবে সে কখনো কল্পনাও করেনি।
তপুর বাবা একদিন বলেছিলেন, “তপু, আমি আর মাস্টার ভাই পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছি। এখন তোরা, আমাদের সন্তানরা লেখাপড়া করে এক সাথে কাজ করে দেশটা গড়ে তোল।”
তাঁর কথাটা শুনে আনুর বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। “চমৎকার কথা বলেছিস্ নুরু। একদম ঠিক কথা বলেছিস্।”
লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পর তপু ভেবেছিল ‘তার বাবা ও মাস্টার কাকার স্বপ্ন চিরদিন অপূর্ণই থেকে যাবে। তার আর আনুর পথ ভিন্ন হয়ে গেছে। পাশাপাশি থাকা আর হল না।’ কিন্তু আজ মজিদ মাস্টার কাকা তাকে একটা নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। আগপাড়ায় ‘নি¤œ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়’ স্থাপনের কাজ শুরু হবে শনিবার থেকে। আনুসহ দশজন শিক্ষক-শিক্ষিকার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে। আর তপু সেই স্কুলের ঘন্টা বাজানোর দায়িত্ব পেয়েছে।
তপুর চোখে এখন স্বপ্ন।
হেড মাস্টার সাহেব বিরতির ঘন্টা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। টং-টং, টং-টং, টুন টুন টুন টুন টুন বেল বাজাল তপু। ঝাঁকে ঝাঁকে ডানা কাটা নীল-সাদা পরী নামছে মাঠে। এক ঝাঁক পরী এগিয়ে আসছে তার দিকে। সানু, সেলিনা, নাজু, টুনি, শামিমা। সবার সামনে ভিন্ন পোশাকের দু’জন। শিক্ষিকা আনু না-স্কুল পড়–য়া আনু আরু উড়না মাথায় ঘোমটা দেয়া কুপি। পুঁথি শুনবে ওরা। এক্ষুনি তাকে ওদের সুর করে ঢুলে ঢুলে পুঁথি পাঠ করে শোনাতে হবে।
ধানক্ষেতের পাশেই পায়ে চলার পথের উপর একটা আম গাছ। সেই গাছের নিচে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। তপু আর আনু। চুপচাপ। ধানগাছের চিরল পাতায় লাগছে দুপুরের রোদ। ঝির ঝির বাতাসে দুলছে ফিকে সবুজ শিষগুলো। ক্ষেতের পাশে তপুর বাড়ির বাইরের আঙিনায় লাউয়ের মাচা। মাচার বাইরে ঝুলে পড়ে দুলছে কচি কচি ডগা। এক হাতে ক’টি ডগা অন্য হাতে কাস্তে নিয়ে তপু আর আনুর দিকে তাকিয়ে আছে তপুর বউ কুপি। চোখে মুখে জোছনা কোমল ¯িœগ্ধতা।
বিশাল সবুজ মাঠের পরে অন্য গ্রাম। সেই গ্রামের স্কুলে নিশ্চয়ই কেউ বাজাচ্ছে টং-টং, টং-টং, টুন টুন টুন টুন টুন টুন। উত্তরের বাতাস ভাসিয়ে আনল সেই শব্দ।