ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৬





জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ

 ধানশালিক ইউটিউব চ্যানেল । সাবস্ক্রাইব করে পাশে থাকুন : https://www.youtube.com/watch?v=7_bEP0d9Rm4 


[গত সংখ্যার পর]
অন্তর সামান্যই হাসল। কিন্তু হাসিতে ভেঙে পড়ল হাসান। তার হাসি আর থামে না। টানা দশ মিনিট হাসার পরও দমকে দমকে তার বুকের ভেতর থেকে হাসি বের হতে লাগল।
বাবা বলল, হাসান, কৌতুকটা কি তুমি এই প্রথম শুনলে?
জি না....হু হু.....স্যার হু...হু....। এবার নিয়ে.....হা হা....মোট তিনবার শুনলাম.....হু হু।
তৃতীয়বারে এমন হাসি! তাহলে প্রথম, দ্বিতীয় বারে কেমন হেসেছিলে?
হু হু.....আগের দু’বার হাসি নাই স্যার হা হা...।
মানে?
আগে যারা বলেছিল তাদের ক্ষেত্রে আমার শোনায় রস ছিল না, মনে রাগ ছিল। বলা যায় অনিচ্ছা নিয়ে শুনেছিলাম।
কেন?
আমি তাদের পছন্দ করি না। প্রথম বার শুনেছিলাম আমার স্যারের ক্রয় ম্যানেজারের মুখে। সে ব্যাটা একটা চোর। যা-ই কেনে তার দাম তিন গুণ বাড়িয়ে লেখে। আর বলে, দিন দিন জিনিসপত্রের দাম যেমন বাড়তেছে তাতে আমার ক্রয় ম্যানেজারের পদ ত্যাগ না করে উপায় থাকবে না। চোরের মুখে কৌতুক শুনে হাসি আসে বলেন স্যার? আর দ্বিতীয় বার .......।
দেখো দেখো.......।

বাবা সামনে আঙুল তুললেন। হাসান আর অন্তর এক সাথে তাকিয়ে দেখল সামনের গাছটায় দু’টো কাঠবেড়ালী লাফাচ্ছে। বাবা বলল, যাক, প্রাণী তো দেখলাম।
আর একটু এগিয়ে পাখিও দেখা গেল। ঘুঘু পাখির মত দেখতে, কিন্তু ঘুঘুর চেয়ে কিছুটা বড়। ১০/১৫ টা পাখি মাটিতে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। বাবা বলল, বনের ঘুঘু বোধ হয় একটু বড় হয়।
হাসান বলল, ওরা ঘুঘু না স্যার। ওদের নাম হরিয়াল। আমাদের গ্রামের ভাষায় ওদেরকে সাতবয়রা বলে।
সাতবয়রা!
ওরা একটু তাল কানা ধরনের। শিকারির আগমন ঠিক বুঝতে পারে না। পাশের একটাকে গুলি করে ফেলে দিলেও অন্যগুলো খেয়াল করে না। এ জন্য ওদের ধরা বা শিকার করা তুলনামূল সহজ। হরিয়ালের মাংস খুব সুস্বাদু।
তুমি অনেক জানো হাসান। আমার টাকা থাকলে তোমাকে বেতন দিয়ে রেখে দিতাম আমার গাইড হিসাবে। তোমার সাথে বছর দশেক থাকতে পারলে মস্তিস্ক অনেকটা পূর্ণ হত। আমার স্টক একেবারেই শূন্য।
এসব খুব সহজ বিষয় স্যার।
সহজ বিষয়ই বেশিরভাগ মানুষের অজানা থাকে। আমি এমন অনেক লোক দেখেছি যারা জানে গাড়ি কিভাবে চালাতে হয়, সমুদ্রে জাহাজ কিভাবে চালাতে হয়। কিন্তু তারা জানে না নৌকায় কিভাবে পাল তোলা হয়। অনেকে বরফের উপর, পাথরের উপর স্ক্যাটিং করতে জানে, কিন্তু জানে না সাঁতার কাটতে। 
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। বাবা বলল, খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
কিন্তু তৃষ্ণা মেটানো সম্ভব নয়। বোতল নেই। পানি কলসে। কলস কাঁধে নিয়ে তো আর হাঁটা যায় না। হাসান বলল, স্যার, সেন্টার শক চুইংগাম মুখে দিন, তৃষ্ণা কিছুটা কমবে।
তুমি কতগুলো চুইংগাম নিয়ে এসেছো?
এনেছি বেশ কিছু।
তাহলে দাও একটা।
ঢিপির মত একটা জায়গা। সেখানে তিন জন বসল পাশাপাশি। সামনে ছোট একটা ঝোপের মত। তারপর কৃষকের ফসলের ক্ষেত। সেখানে ইরি ধানের চারা গজিয়েছে। ওরা নিশ্চয় বনের প্রান্তে চলে এসেছে।
বাবা বলল, হাসান, একটা গান গাও।
স্যার, আমি গান জানি না।
গান জানো না! গান জানে না এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে নাকি? বাথরুমে গান গাওনি কখনো?
অনেক দিন বাথরুমেও গাওয়া হয় না।
কেন?
আমার বাথরুমের পাশেই সেই চোর ম্যানেজারের শোবার রুম। আমি গান ধরলেই সে চিৎকার করে উঠে-দুনিয়ায় শান্তি বলে কি কিছু থাকতে নেই, নাকি?
তাহলে কবিতা শোনাও। তুমি বাংলায় মাস্টার্স। কবিতা জানি না-এমন কথা বলতে পারবে না। যাও, জীবনানন্দের মধ্যে যাও।
হাসান আবৃত্তি করল-
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে-সবচেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে মধুকূপি ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নামঃ কাঁঠাল, অশ্বখ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণঃ
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গা সাগরের বুকে-সেখানে
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্মীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;
সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রুপসীর শরীরের পর-
শঙ্খমালা নাম তার; এ বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো-বিশালক্ষ্মী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
হাসানের আবৃত্তি শুনে বাবা তো যারপর নাই মুগ্ধ। মুগ্ধ অন্তরও। সে এর আগে টিভিতে কোনো কোনো নাটকে আবৃত্তি শুনেছে। অনেক আগে মা একটা আবৃত্তির ক্যাসেট কিনেছিলেন। ক্যাসেটটার নাম হাড়ের ঘর। যতদূর মনে পড়ে আবৃত্তিকার শিমুল মুস্তাফা। অন্তর তখন ক্লাশ ফোরে। মা তখন দুপুরে বা বিকেলে অবসরে ক্যাসেটটি বাজিয়ে শুনতো। অন্তর তখনও আবৃত্তি বোঝে না। তাই মন দিয়ে সে সব শোনেনি। কিন্তু সেই কন্ঠ তার কানে লেগে আছে। হাসানের আবৃত্তির সাথে সেই আবৃত্তির মিল খুঁজে পেল সে। প্রায় সেই রকম কন্ঠ। সেই রকম বলার ধরন।
বাবা বলল, হাসান, আমার যদি অনেক টাকা থকতো তো আমি তোমাকে বেতন দিয়ে রাখতাম আবৃত্তি শোনার জন্য। আগের দিনের        রাজ-রাজারা বেতন দিয়ে গায়ক রাখতো, বাদক রাখতো, ভাড় রাখতো। আমি রাখতাম আবৃত্তি শিল্পী। তোমাকে নিয়ে এই চন্দ্রার বনে এসে এই ঢিপির উপর বসে থাকতাম। তুমি আমার পাশে বসে একের পর এক জীবনানন্দ আবৃত্তি করে যেতে। তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো-বিশালক্ষ্মী দিয়েছিল বর/তাই সে জন্মেছে বাংলার ঘাস আর ধানের ভেতর। আহ! কি কথা। কি উপমা। বাংলা ঘাস আর ধান ছাড়া আর কোথাও তাকে পাওয়া যাবে না।
অন্তর বাবার জন্য একটু কষ্ট পেল মনে। বাবার মনে অনেক ভাল ইচ্ছা, কিন্তু টাকার জন্য সেসব ইচ্ছা পূরণ করতে পারছে না। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যাদের মনে শুধুই খারাপ ইচ্ছা। অথচ তাদের অনেক টাকা আছে।
হাসান বলল, স্যার, আবৃত্তি শোনার জন্য এই চন্দ্রার বনে আসতে হবে কেন? এই ঢিপির উপরই বা বসতে হবে কেন? যে কোনো জায়গায় বসেই তো আবৃত্তি শোনা যায়।
তা যায়। এখন কেন যেন মনে হল, এই ঢিপির উপর বসে আবৃত্তি শুনলে যতটা ভাল লাগবে অন্য কোথাও বসে শুনলে ততটা লাগবে না। এই বাংলার ঘাস-লতা-পাতা কত সুন্দর। অথচ আমরা অনেকেই চোখ মেলে তা দেখি না। দেখবো কেমন করে? আমাদের সবার ভাবনা-কেমনে চুরি করবো, জোচ্চরি করবো, কেমনে বাড়ি করবো, কেমনে গাড়ি করবো এই সব। চুরি-চামারির ধান্দায় থাকলে সুন্দরের কথা মনে থাকে? চোরের মনে কখনো কাব্যিকতা আসে? দেশ যারা চালায় তারা সবাই হল.......।


বাবা চলে যাচ্ছে রাজনীতিতে। এখন রাজনীতিকদের এক হাত নেবে। তার আগেই তাকে থামিয়ে দেয়া উচিত। এই সবুজ প্রকৃতির মাঝে বসে রাজনীতি আর গালাগাল কারও ভাল লাগার কথা না।
অন্তর বলল, বাবা, তুমি কথা বলতে বলতে রাজনীতির মধ্যে ঢুকে যাও। এটা তোমার মুদ্রা দোষ। আমার মনে হয় এই দোষটা তোমার ত্যাগ করা উচিত। এই প্রকৃতির কোলে বসে চোর-জোচ্চর নিয়ে কথা বলা মানায়?
দুঃখিত, গাড়ি যখনই লাইনচ্যুত হতে যাবে তখনই তুই তাকে লাইনে তুলে দিবি। সামনের ঝোপটায় তাকা। সাদা আর হলুদ ফুল ফুটে আছে। ঐ গাছটা চেয়ে দেখ। গাছটা বেয়ে যে লতাগুলো উঠেছে। ওগুলো কি স্বর্ণলতা? কি সুন্দর না দেখতে?
বাবা, জীবনানন্দের কবিতা শোনার পর তোমার চোখ খুলে গেছে। প্রকৃতির সবকিছু এখন তোমার চোখে সুন্দর লাগছে।
কেন, তোর চোখে সুন্দর লাগছে না? বড় করে শ্বাস নে’। গন্ধটা কেমন মিষ্টি না?
অতটা মিষ্টি না, কেমন ঝাঁঝালো।
কি বলিস!
বাবা চিৎ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে আবৃত্তি করল-
টহফবৎ ঃযব মৎববহড়িড়ফ ঃৎবব
ডযড় ষড়াবং ঃড় ষরব রিঃয সব
অহফ ঃঁৎহ যরং সবৎৎু হড়ঃব
টহঃড় ঃযব ংবিবঃ নরৎফ’ং ঃযৎড়ধঃ-
ঈড়সব যরঃযবৎ, পড়সব যরঃযবৎ, পড়সব যরঃযবৎ!
ঐবৎব ংযধষষ যব ংবব
ঘড় বহবসু
ইঁঃ রিহঃবৎ ধহফ ৎড়ঁময বিধঃযবৎ
ডযড় ফড়ঃয ধসনরঃরড়হ ংযঁহ
অহফ ষড়াবং ঃড় ষরাব র’ ঃযব ংঁহ.
ঝববশরহম ঃযব ভড়ড়ফ যব বধঃং
অহফ ঢ়ষবধংবফ রিঃয যিধঃ যব মবঃং
ঈড়সব যরঃযবৎ, পড়সব যরঃযবৎ, পড়সব যরঃযবৎ!
ঐবৎব ংযধষষ যব ংবব
ঘড় বহবসু
ইঁঃ রিহঃবৎ ধহফ ৎড়ঁময বিধঃযবৎ.
বাবার আবৃত্তিও কিন্তু মন্দ হল না। হাসান বলল, স্যার, আমি ইংরেজি কবিতা এত সুন্দর করে আবৃত্তি করতে পারতাম না।
বাবা হাসানের কথায় না গিয়ে বললন, মনোবিজ্ঞানীরা বনকে কিসের সাথে তুলনা করেছেন, জানো?
জি না স্যার।
মেয়েদের চোখের সঙ্গে।
কেন?
মেয়েদের চোখ যেমন রহস্যময়, বনও তেমন।
মেয়েদের চোখ রহস্যময়! জানতাম না তো। জানতাম, মেয়েদের মন রহস্যময়।
চোখ রহস্যময় না হলে মন রহস্যময় হয়?
বাবা বনের সৌন্দর্যে, রহস্যময়তায় মুগ্ধ। তাকে আরও মুগ্ধ করতে আমি বললাম, বাবা, বনকে অসাধারণ দেখতে লাগে কখন জানো?
কখন?
জ্যোৎস্না রাতে।
বাবা শোয়া থেকে ঝট করে উঠে বসল। তার কপাল কুঁচকে গেল। চোখ ছোট হয়ে গেল। বলল, জ্যোস্না রাতে বনকে সুন্দর দেখায় মানে?
আমি একটা গল্পে পেয়েছি বাবা। গল্পের নায়ক পূর্ণিমার রাতে একাকি এই চন্দ্রার বনে এসে সারা রাত বসে থাকতো। তার একটা খালাত ভাই ছিল। সে নায়কের ভক্ত হয়ে যায়। শেষে তারা দু’জন আসতো।
এসে কী করতো? বসে বসে জ্যোৎস্না দেখতো?
জ্যোৎস্না দেখতো বলা ঠিক না, জ্যোৎস্নায় বনের প্রকৃতি দেখতো। শেষ রাতে নাকি বনটাকে ভৌতিক দেখায়। একটু একটু বাতাস বয়। গাছগুলোকে মনে হয় জীবন্ত।
গাছগুলো তো জীবন্তই।
সেই বইয়ে নায়কের খালুও এই প্রশ্ন করেছিল। নায়ক কী উত্তর দিয়েছে জানো?
কী?
গাছগুলো জীবন্ত কিন্তু সুপ্ত। পূর্ণিমার শেষ রাতে গাছগুলো যেন জেগে ওঠে।

এবার বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত মানে বাবা রেগে গেছে। চোয়াল যত শক্ত, রাগ তত বেশি। মনে হচ্ছে বাবার চোয়াল অসম্ভব রকম শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অন্তর বুঝতে পারছে না যে, সে রাগের কী কথা বলেছে।
বাবা চোয়াল শক্ত করেই বলল, লেখকরা আনরিয়াল জগতের বাসিন্দা। সে সব বিশ্বাস করে তুইও আনরিয়াল জগতে চলে যাচ্ছিস-চলে যাচ্ছিস বলেই গল্প লিখতে বসেছিস। তোর সৌভাগ্য যে, আমি তোকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছি।
বাবা, তুমি কিন্তু একটু আগে জীবনানন্দের কবিতার প্রশংসা করেছো।
কবিতা আর গল্পের কথা এক হল? কবিতা তৈরী হয় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ফালতু কল্পনা কবিতায় থাকে না। এক মানুষ সারা রাত জঙ্গলে বসে থাকবে জ্যোৎস্না দেখতে। ফালতু কল্পনা সব! এখানে প্রকৃতির কোনো সৌন্দর্যের বর্ণনা আছে? বলা হয়েছে, গাছ জীবন্ত হয়ে ওঠে। এখানে জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য কোথায়? কোনো সুস্থ মানুষ সারা রাত জঙ্গলে বসে থাকবে না-থাকবে শুধু পাগল। ছোট বেলায় আমাদের গ্রামে এরকম একজন পাগল দেখেছিলাম। সে ল্যাংটা হয়ে থাকতো। কেউ কোনো কাপড় পরতে দিলে বলতো-আল্লায় পাঠাইছে ল্যাংটা কইরা, তুমরা আমারে কাপড় পরতে কও ক্যান? সেই ল্যাংটা পাগল শীতের রাতে সারা রাত কলাই খেতে বসে থাকতো। সে অবশ্য পূর্ণিমা-অমাবশ্যা সব সময়ই থাকতো। গল্পের সেই নায়ক কি ল্যাংটা হয়ে থকতো?
না, সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে থাকতো। পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি পরে সে পথে পথে হাঁটতো খালি পায়ে।
তাহলে তো সেটাও একটা পাগল। বলা যায় হলদি পাগল। চল, উঠি। দুপুরের খাবার খেয়ে ঢাকা চলে যাব।
খাবার খেয়ে ঢাকা চলে যাবে? সারাদিন বনে থাকবে বলে এলে না?
তুই তো সারাদিন থাকার বারোটা বাজিয়ে দিলি। ফালতু এক কথা বলে মেজাজ দিলি ফোরটি নাইন করে। ফোরটি নাইন মেজাজ নিয়ে আর বনে থাকতে ভাল লাগবে না।
বাবা উঠে হাঁটা শুরু করল। অন্তর আর হাসান পেছনে। তারা তাকাল পরস্পরের মুখে। কী বলবে কেউ তা বুঝতে পারল না।
বাবা খাওয়াটা শেষ করল নীরবে। অন্তর বলার মত কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। হাসান বলল, স্যার, আপনি যে এত সহজে রাগ করতে পারেন আমি তা বুঝতেই পারিনি।
তুমি কি মনে কর যে, অন্যের সব কিছু বোঝার ক্ষমতা তোমার আছে।
আমি অন্যের সাথে কথা বলে, অন্যের মুখ দেখে তার সম্পর্কে মোটমোটি একটা ধারণা করতে পারি। কিন্তু আপনার সম্পর্কে কেন পারলাম না তা বুঝতে পারছি না। অবশ্য আপনার রাগটা আসল না-ও হতে পারে।
রাগেরও আসল-নকল আছে? ভেজালের সাথে বাস করতে করতে আমরা আর কিছুকেই আসল মনে করতে পারি না। হয়তো এমন এক সময় আসবে যে, খাঁ খাঁ জ্যোৎস্নায় বনের মধ্যে বসে থেকে ভাববো, জ্যোৎস্নাটা আসল না নকল? বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভাববো, বৃষ্টিটা কি আসল? রোদে পুড়তে পুড়তে ভাববো, রোদটা বোধহয় আসল না।

(৫)
ঢাকায় ফিরে বাবা ব্যস্ত হয়ে গেল তার অফিস নিয়ে। অন্তর ব্যস্ত তার স্কুল, নতুন ক্লাশের পড়াশোনা নিয়ে। মা কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, বনে বেড়ানো কেমন উপভোগ করলি?
অন্তর বিস্তারিত কিছু বলেনি। মোটামোটি, মন্দনা-এ জাতীয় উত্তর দিয়ে সরে গেছে। মা বলেছে, গুছিয়ে লিখে রাখ। আগামি বছর স্কুল ম্যাগাজিনে দিয়ে দিস। স্কুল জীবন শেষ করেও পড়তে পারবি। ভাল লাগবে তখন।
মা চায় অন্তর কিছু কিছু লিখুক। লেখাটা বোধহয় মা’র ভাল লাগে। কিন্তু বাবার কাছে লিখতে যাওয়া মানেই ফেঁসে যাওয়া-জীবন ত্যাজপাতা হয়ে যাওয়া। যে যত বড় লেখক তার জীবন তত বড় ত্যাজপাতা।
বন ভ্রমনের সপ্তাহ খানেক পর বাবা অন্তরের ঘরে এল। অন্তর তখন মন দিয়ে প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করছিল। প্যারাগ্রাফের নাম-এ্যা মেমোরিবাল ডে অফ ইওর লাইফ। বাবা বলল, মেমোরিবাল ডে নিয়ে প্যারাগ্রাফ লিখতে হয়, ম্যামোরিবাল নাইট নিয়ে লিখতে হয় না কেন?
অন্তর বলল, মেমোরিবাল নাইট লিখতে বসলে তো তার বেশির ভাগ চলে যাবে ঘুমের কথা লিখতে।
এমন কোনো রাত তো মানুষের জীবনে থাকতে পারে যে রাতে একেবারেই ঘুম হয়নি।
সবার জীবনে সেরকম রাত থাকে না, কারও কারও জীবনে থাকে হয়তো।
ধর, তোর জীবনে সেরকম একটা রাত এল।
আমার জীবনে সেরকম রাত আসার সম্ভাবনা নেই। আমি কি পারবো গল্পের সেই হলুদ পাঞ্জাবি পরা নায়কের মত রাত-বিরাত ঘুরে বেড়াতে?
বাবা অন্তরের দিকে একটু সরে বসল। অন্তরের মুখে ক্ষাণিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, দুই যুবক যে সারা রাত চন্দ্রার বনে জ্যোৎস্না দেখেছে সেই বইয়ের লেখক কে?
হুমায়ূন আহমেদ।
তাই বল। উরুগুয়ের ছোট গল্পকার হোরসিও কিরোগো বলেছেন-তখনই গল্পটি বলবে যখন এর কয়েকটি চরিত্রের মধ্যে তুমি থাক। এ ছাড়া গল্পের মধ্যে জীবনকে ফুটিয়ে তোলার কোনো উপায় নেই। বিশ্বসাহিত্যের মহিরুহ দক্ষিণ আমেরিকার কবি পাবলো নেরুদাকে একবার একজন বলেছিলেন-আপনার লেখা তো আপনার জীবনেরই অভিক্ষেপ। নেরুদা কী বলেছিলেন জানিস? নেরুদা বলেছিলেন-এমনই তো-এখানেই একজন শিল্পী, জীবন শিল্পী। শুধু কল্পনা আর অভিজ্ঞতাহীন অবাস্তবতা নিয়ে তো সাহিত্য হতে পারে না।
অন্তর তাকাল বাবার মুখে। ওর চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময়। বাবা কী বলতে চাইছে?
বাবা বললেন, খুব অবাক হচ্ছিস যে, আমি উরুগুয়ের লেখকের খবর পেলাম কী করে? তুই আর তোর মা মনে করিস, আমি পত্রিকায় শুধু রাজনৈতিক কাঁদা ছুড়াছুড়ির খবর পড়ি। তোদের মনে করাটা ঠিক আছে। তবে আমি সাহিত্যের খোঁজ-খবরও রাখি-কিছু পড়িও।
তা জানি বাবা।
কোন লেখক যেন বলেছিলেন, আমি যা দেখিনি তা কখনোই লিখব না। কে বলেছিলেন তুই জানিস?
না।
দাঁড়া হাসানকে ফোন করি। সে নিশ্চয় জানবে। বাংলায় মাস্টার্স। বইও তো পড়ে প্রচুর।
বাবা হাসানকে ফোন করল। ফোন রিসিভ হলে বাবা হাসি মুখে তাকাল অন্তরের দিকে। ফোন রিসিভ হলে বাবার মুখে হাসি ফোটে। তার মধ্যে সন্দেহ থাকে যে, ফোনটা ব্যর্থও হতে পারে। বাবা এখনও ল্যান্ড ফোনের ধারণা নিয়ে আছে। বাবা আর হাসানের কথোপকোথন-
হাসান, তুমি কি জানো কথাটা কে বলেছেন?

কোন কথা স্যার?
যা আমি দেখিনি তা কখনো লিখব না।
ও....., আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।
তুমি সিওর?
নাইনটি নাইন পার্সেন্ট সিওর।
যথেষ্ট। আজকাল এতটা সিওরিটি দিয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। ধরো, কোনো নেতা বক্তৃতায় বলল, আমি নির্বাচিত হলে আপনাদেরকে এমন এলাকা উপহার দেব, যে এলাকায় একটাও ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল থাকবে না। তার এই কথার মধ্যে কত পার্সেন্ট সিওরিটি পাওয়া যেতে পারে? টু পার্সেন্ট? নাকি তারও কম? সে নির্বাচিত হলে দেখা যাবে, তার এলাকায় কোনো ম্যানহোলের ঢাকনাই নেই। তার লোকজন সব ঢাকনা চুরি করে বিক্রি করে টাকা কামিয়েছে। সে টাকা সামান্য। তাই তারা নতুন ঢাকানার জন্য টেন্ডার ছাড়তে যাচ্ছে। সেই টেন্ডার নিয়ে কঠিন মারামারি হবে নিশ্চয়। একজনের হাঁটুতে গুলি লাগবে। আরেকজনের......।
অন্তর দেখল, গাড়ি লাইন চ্যুত হয়ে যাচ্ছে। বাবা মূল কথা থেকে সরে রাজনীতির দিকে চলে যাচ্ছে। সে বাবাকে চোখ ইশারা করল। বাবা বলল, আচ্ছা রাখি, অন্তরের সাথে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। পরে তোমাকে বিস্তারিত জানাব।
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা! এখানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কী হচ্ছে? বাবার বিশ্বাস ছিল, লেখকরা কল্পনার জগতবাসী। বাস্তবের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। হঠাৎ বাবা প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, লেখকরা বাস্তবতার বাইরে গিয়ে কিছু লেখে না। এটা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।
বাবা সেলফোন পকেটে রেখে বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম। ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সি-এর লেখক। পড়েছিস বইটা? অসাধারণ এক গল্প। টানা ৮৪ দিন মাছ ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পর ৮৫তম দিনে ওল্ড ম্যান বিরাট আকৃতির একটা মার্লিন মাছ ধরে। তারপর তিন দিন ধরে সংগ্রাম চলে মাছটিকে তীরে বয়ে আনার। আর শেষ পর্যন্ত জেলেটি যে মাছ নিয়ে তীরে ফেরে তাও পূর্ণাঙ্গ মাছ না। হাঙরে খাওয়া বিশাল কাটাসহ মাছের ভগ্নাংশ। ওল্ডম্যান উপলব্ধি করতে পারে, মানুষ ধ্বংস হয় কিন্তু পরাজিত হয় না। বইটার বাংলা একটা কপি তোকে যোগার করে দেব। পড়তে পড়তে তোর মনে হবে, তুইও যেন সেই বৃদ্ধের সাথে সমুদ্রে অবস্থান করছিস।
গল্পের মূল কাহিনী জেনেই অন্তরের বইটা পড়তে ইচ্ছে করল খুব। সে নিশ্চিত কালকের মধ্যেই বাবা তাকে বইটার একটা কপি এনে দেবে। বাবা বলল, যা বলছিলাম, লেখক যখন বলেছেন যে, জ্যোৎস্না রাতের অন্যরকম একটা ইফেক্ট আছে, তখন নিশ্চয় আছে। অভিজ্ঞতা না থাকলে তিনি এ কথা বলতে পারতেন না।
বুঝলাম, কিন্তু..........।
কালকের পরের রাত পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমার রাতটা আমরা চন্দ্রার বনে কাটাবো। তোর জীবনে এসে যাবে একটা মেমোরিবাল নাইট লেখার সুযোগ।
অন্তর যেন ধপ করে আকাশ অথবা ছাদ থেকে পড়ল। বাবা এসব কী বলছে? চন্দ্রার বনে রাত কাটাবে! তা কী করে সম্ভব? গল্পের হিমু হওয়া অসম্ভব। অন্তর বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে বাবা?
মাথা খারাপ হবে কেন? মাথা খারাপ হলে মানুষ জ্যোৎস্না রাতে বনে থাকতে চায়?
তুমি কী করে ভাবো যে, মা আমাদের সারা রাত বনে থাকতে দিতে রাজি হবে?
প্রথমে রাজি হবে না। তাকে রাজি করাতে হবে। আচ্ছা, হাসানকে ফোন করি, সে যদি আমাদের সঙ্গি হয় তো সোনায় সোহাগা। তার মত একজন বাংলায় মাস্টার্স সাথে থাকা মানেই বাড়তি সুবিধা।
বাবা আবার হাসানকে ফোন করল। তাদের কথোপকোথন-
হাসান, আবার ফোন করলাম, বিরক্ত হচ্ছো না তো?
কি যে কলেন স্যার! আপনি ফোন করছেন আমার কি যে ভাল লাগছে!
কী করছিলে তুমি?
কিছু করছিলাম না। বসে বসে একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।
বিষয়টা কী?
সেটা আপনাকে বলতে চাই না স্যার।
কেন?
বিষয়টা আপনার পছন্দের নয়। আপনার কাছে সেটা আনরিয়াল ইমাজিন।
তুমি বলো, বিষয়টা কী?
আপনি আবার রেগে যাবেন না তো?
কথা দিচ্ছি রাগবো না। তুমি নিশ্চিন্তে বলো।
আমি ভাবছিলাম, অন্তরের সেই কথাটা নিয়ে। দুই যুবক সারা রাত চন্দ্রার বনে জ্যোৎস্না দেখেছিল। বইটা আমি যোগার করে পড়েছি। বইটা পড়ার পর থেকে আমারও ভীষন ইচ্ছে করছে, যদি একটি জ্যোৎস্না রাত কোনো এক বনে বসে কাটাতে পারতাম। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা! লাখে এক জনেরও এই অভিজ্ঞতা থাকে না।
হাসান, তোমার কথা শুনে এখন আমার নৃত্য করতে ইচ্ছে করছে। তুমি কাছে থাকলে আমি তোমার চারপাশ ঘিরে নৃত্য করতাম। শোনো, আগামি পরশু রাতটা হল পূর্ণিমার রাত। আমি আর অন্তর ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে, সে রাতে আমরা দু’জন চন্দ্রার বনে সেই ঢিপিটার উপর বসে থাকবো। তুমি কি আমাদের সাথে থাকবে?
সিওর সিওর। স্যার, আমি আছি আপনাদের সঙ্গে।
সেই গল্পে জ্যোৎস্না দেখেছিল দুইজন। আর আমরা দেখবো তিনজন। নিশ্চয় বাড়তি আনন্দ পাব।
স্যার, আমরা চারজনও হতে পারি।
কীভাবে?

কাল আমার ছোট ভাইটা ঢাকা আসবে। হয়তো সেও আমাদের সঙ্গি হবে।
বাহ! দারুন খবর। খবরটা অন্তরের জন্য বেশি আনন্দের। সমবয়সী সঙ্গি পাচ্ছে। আনন্দের মাত্রা যদি বেশি হয় তো পরবর্তীতে আমরা লোক সংখ্যা আরও বাড়াবো। কথায় আছে না-যত গুড় তত মিষ্টি। আমরা বনের ভেতর হাত ধরাধরি করে গাইবো- আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে জঙ্গলে।
জঙ্গলে না স্যার, বনে।
বাবা সেলফোন পকেটে রেখে বললন, হাসানও আমাদের সঙ্গি হচ্ছে। শুধু হাসান না, ওর ছোট ভাইটাও। কালই সে ঢাকা আসছে। মজার ব্যাপার হল-গল্পে জ্যোৎস্না অবলোকনের ব্যাপারটা আমাকে যেমন ভাবিত করেছে, হাসানকেও তেমন। ও ইতোমধ্যে সেই বইটা যোগার করে পড়েও ফেলেছে।
বাবা খুবই উৎফুল্ল। মানুষ উৎফুল্ল হলে বোধহয় বেশি কথা বলে। আর দুঃখ পেলে থাকে চুপ। অন্তর কিছু বলার পাচ্ছিল না। তার একটাই বিশ্বাস, রাতের বেলা তারা বনে যেতে পারবে না। মা কিছুতেই তাদের যেতে দেবে না। তখন বাবার সব উৎফুল্লতা উবে যাবে।
বাবা দম নিয়ে বলল, তাহলে বিষয়টা নিয়ে কাল তোর মায়ের সাথে কথা বলবো। জানি, সে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সে বাঁধার পাহাড় আমরা ডিঙিয়ে যাব। সব বাঁধা পেরিয়ে আমরা যাব চন্দ্রার বনে জ্যোৎস্না অবলোকোনে।
বাবা চলে গেলে অন্তরের আর পড়ায় মন বসল না। মাথায় নানা ভাবনা এসে ভিড় করল। বাবা তো সিরিয়াস হয়ে গেছে যে, জ্যোৎস্না রাতে বনে যাবে। বনের সৌন্দর্য অবলোকন করবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি ঠিক হবে? সাহিত্য যতই বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে হোক, তার সাথে কল্পনার মিশ্রন থকেই। বাস্তবে হুমায়ূন আহমেদের হিমু হওয়া অসম্ভব। রাতের বেলা বনের মধ্যে বসে থাকায় বিপদ-আপদ হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি।
অন্তরের এরকম ভাবনার মুহূর্তে মা এসে হাজির। তার মুখটা কঠিন। মা বলল, কী করছিস?

তার কন্ঠটাও কঠিন। কেমন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল যেন। অন্তর বলল, কিছু না মা।
কিছু না করাই স্বাভাবিক। বাপ তো তোর মাথা থেকে পড়ালেখা সব বের করে দিচ্ছে।
অন্তর মা’র মুখে হাঁ করে চেয়ে রইল। বাবা মাথা থেকে পড়ালেখা বের করছে কীভাবে? মা বলল, সত্যি করে বলতো কী হচ্ছে এসব?
কী হচ্ছে?
বাপ-বেটা মিলে নাকি সারা রাত জঙ্গলে থাকার পরিকল্পনা করেছিস?
মাজেদা দরজায় কান পেতে ছিল। সে মাকে আগেই রাগিয়ে দিয়েছে। অন্তর ভেবে দেখল, কথাটা অস্বীকার করা ঠিক হবে না।
সে বলল, হ্যাঁ মা, আমরা পরশু পূর্ণিমার রাতটা চন্দ্রার বনে কাটাবো বলে ঠিক করেছি। হাসান আঙ্কেলও আমাদের সাথে থাকবে। তার ছোট ভাই-আমার ক্লাশে পড়ে তারও থাকার সম্ভাবনা আছে। চন্দ্রার বনে ঢিপির মত একটা জায়গা আছে। সেই ঢিপির উপর বসে আমরা জ্যোৎস্না রাতের শোভা উপভোগ করব। জ্যোৎস্না রাতে বন-প্রকৃতির শোভা অন্য রকম দেখায়। ঘন্টায় ঘন্টায় ইফেক্ট চেঞ্জ হয়।
ইফেক্ট সব সময়ই চেঞ্জ হয়।
কিন্তু সেটা মানুষের কাছে সেভাবে ধরা পড়ে না। যেমন-এক ঘন্টা আগের ইফেক্ট আর বর্তমানের ইফেক্টের বিশেষ পার্থক্য তুমি বুঝতে পারছ না। জ্যোৎস্না রাতে বনে এই পার্থক্যটা ভাল বোঝা যায়। শেষ রাতে প্রকৃতি অনেকটা ভৌতিক রূপ ধারণ করে।
তখন সত্যিকারে ভূতও তোদের আক্রমন করে বসবে দেখিস।
তুমি কি ভূতে বিশ্বাস করো মা?
অবশ্যই। ভূত-পেত্মি, জ্বিন-পরী, দত্য-দানব সব কিছুতেই আমার অগাধ বিশ্বাস। তোরা যখন জ্যোৎস্নায় প্রকৃতির রূপ অবলোকনে মগ্ন থাকবি, তখন ভূত এসে তোদের ঘাড় মটকে দেবে। বন্য প্রাণী তো আছেই। সেই সাথে আছে চোর-ডাকাত-বন দস্যু। সবাই মিলে তোদের জঙ্গলে জ্যোৎস্না দেখার সাধ মিটিয়ে দেবে। তাই বলে গেলাম-আজ রাতের মধ্যে তুই তোর সিদ্ধান্ত পাল্টাবি। কাল তোর বাপের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে সাহায্য করবি। যদি তা না করে তোরা জঙ্গলে যাস, তাহলে সব কিছুর হাত থেকে জান বাঁচিয়ে আসতে পারলেও আমাকে পাবি না।
তুমি কোথায় যাবে মা?
সমুদ্রে যাব। গলায় একটা কলসি বেঁধে সমুদ্রে ঝাপ দেব। পাগলের আস্তানা থেকে রক্ষা পাওয়ার এটাই একমাত্র পথ।
বলো কী!
যা বলছি ঠিকই বলছি। ১০০% সত্যি বলছি। চলি-গুড নাইট।
মা ভীষণ রেগে গেছে। এরকম অবস্থায় মাকে রেখে বনে যাওয়া মোটেও ঠিক হবে না। আর মা’র আশঙ্কাও অমূলক নয়। রাতের বেলা বনের মধ্যে বিপদ হওয়াই স্বাভাবিক। যে দেশে দিনের বেলা ব্যস্ত পথে-ঘাটে মানুষ অহরহ বিপদে পড়ে যাচ্ছে সে দেশে.........!
কিন্তু বাবাও তো সিরিয়াস। তাকে কি সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যাবে? অন্তর কী করবে তা বুঝতে পারছে না।
পরদিন বাবা অফিস থেকে ফিরল এক তোড়া ফুল নিয়ে। তোড়ায় বেশির ভাগ বেলি ফুল। চারপাশে কয়েকটা রজনীগন্ধা, আর চারটা শাপলা। বেলি ফুল মা’র প্রথম পছন্দের ফুল। তারপর শাপলা ও রজনীগন্ধা। বাবার প্রথম পছন্দ কদম। অন্তরের বেলি ও কদম সমান সমান পছন্দ।
বাবা হঠাৎ মা’র প্রিয় ফুলগুলো দিয়ে তোড়া সাজিয়ে আনল কেন? আজ যে বিশেষ কোনো দিন তা তো মনে হয় না।
বাবা ফুলের তোড়াটা বারান্দার এক কোণায় নামিয়ে রাখল। গ্লাস ভরে পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিল ফুলের গায়ে। তখনই অন্তর গিয়ে দাঁড়াল বাবার পাশে। বাবা অন্তরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে একটু হাসল। বলল, কেমন সুন্দর না?

হু।
পানি ছিটিয়ে দিলাম। ফুলগুলো নিশ্চয় ভাবছে এখন বৃষ্টি হচ্ছে।
কিন্তু হঠাৎ ফুল কেন বাবা?
তোর মায়ের জন্য।
মা’র জন্য ফুল কেন?
কাল রাতে যে আমরা চন্দ্রার বনে যাচ্ছি সে কথাটা এখন তোর মাকে বলবো। ফুল দিয়ে মনটাকে নরম করে নিতে চাই।
 তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। মা সব জেনে গেছে।
জেনে গেছে!
তোমাকে তো বার বার বলছি, মাজেদার কারণে আমাদের কারও মাঝে গোপন বলে কিছু থাকবে না। ওকে এই অভ্যাস ত্যাগ করতে বলবে, না হয় ওর বিরুদ্ধে অন্য কোনো ব্যবস্থা নেবে?
ও কিন্তু মন্দ কিছু করেনি।
মন্দ করেনি!
তোর মা আজ হঠাৎ করে আমার মুখ থেকে কথাটা শুনলে ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠত। জ্বলে যা ওঠার গতকালই উঠেছে। আগুন জ্বলে ওঠার পর আস্তে আস্তে নিভতে থাকে। রাগ হল আগুনের মত। তোর মায়ের রাগ নিশ্চয় অনেকটা কমে এসেছে। মাজেদা আমার কাজটাকে সহজ করে দিয়েছে।
মা তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
কী সিদ্ধান্ত?
আমরা যদি চন্দ্রার বনে জ্যোৎস্না দেখতে যাই তো মা গলায় কলসি বেঁধে সমুদ্রে ঝাপ দেবে।
স্রেফ আমাদের ভয় দেখাবার জন্য বলা। বিষ খাব, গলায় দড়ি দেব, গলায় কলসি বাঁধবো এরকম কথা বলা মেয়েদের ফ্যাশন। তুই তোর মাকে চা নিয়ে আসতে বল। আমি ফুলের তোড়া এগিয়ে ধরে হাসি মুখে তাকে কথাটা বলবো।
মাকে চা আনতে বলতে হল না। মা নিজে থেকে চা নিয়ে এল। সাথে টা-মানে বাবার প্রিয় ডাল পুড়ি। প্লেটের ওপর পুড়িগুলো পেট ফুলিয়ে আছে। কালোজিরার সুবাস ছড়াচ্ছে। বাবার পুড়ির আবার বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। পুড়িটা যখন পেট ফুলিয়ে দেয় তখন সেটাকে কড়াই থেকে তুলে তার ফোলা পেট একটু ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয় গুলানো ডিম। তারপর সেটাকে আবার তেলের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। এবার ডিমসহ পুড়িটা দ্বিগুণ পেট ফুলিয়ে দেয়। হয়ে যায় ডিম-ডাল পুড়ি।
অন্তর অবাক হল যে, সবকিছু জানা সত্ত্বেও মা কেন এত শান্ত? একেবারে পুড়ি ভেজে......! তার মানে মা কি সব মেনে নিয়েছে?
বাবা মা’র হাতে ফুল তুলে দিল। মা হাসিমুখে সে ফুল গ্রহণ করল। মিষ্টি করে বলল-ধন্যবাদ-অনেক অনেক ধন্যবাদ।
বাবা পুড়ি আর চা খেতে লাগল। মা বলল, আমার বান্ধু সুবর্ণার কথা তোমার মনে আছে?
বাবা পুড়িতে কামড় দিতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ এরকম একটা প্রসঙ্গ?
বলল, মনে থাকবে না কেন? ওর বিয়েতে না আমরা গেলাম। ওর স্বামীর এক চোখ টেরা। অনেকেই বলছিল, ওমা! জামাই দেখছি দেড় ব্যাটারি।
সুবর্ণার বড় বোন অপর্ণার কথা মনে আছে?
হ্যাঁ, তাও মনে আছে। তার স্বামীর নাম মিরকাত আলী না কি যেন। লোকটার মাথায় বোধহয় একটু সমস্যা আছে। সারাক্ষণ কথা বলছিল।
আরে ধুর! তার মাথায় সমস্যা থাকবে কেন? যার কাজ অন্যের মাথার সমস্যা দূর করা, তার মাথায় সমস্যা থাকলে চলবে?
অন্যের মাথার সমস্যা দূর করা মানে?

তিনি বিরাট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছেন। মালিবাগে চেম্বার দিয়ে বসেছেন। রোগির নাকি অসম্ভব ভিড়। সাতদিনে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। আমি সুবর্ণাকে ফোন করে সিরিয়াল নিয়ে রেখেছি।
তুমি সিরিয়াল নিয়েছো কেন?
তোমার ব্যাপারে একটু কথা বলতে....চলো কাল সন্ধ্যায় যাই।
বাবা মুখভর্তি পুরি নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল মা’র মুখে। হাঁ বন্ধ করে না, চোখের পলকও ফেলে না।
মা বাবার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল, ওভাবে তাকিয়ে আছো যে? তোমার সমস্যাটা যে জটিল তা বলছি না। মাঝে মাঝে এমনটি হতে পারে। তুমি তো বাইরে কোথাও যাও না। অফিস টু বাসা, বাসা টু অফিস। হঠাৎ করে ছেলেকে নিয়ে চন্দ্রার বনে বেড়াতে গিয়ে তোমার মনে এক ধরনের আবেগ জেগে উঠেছে।
আবেগ মানে?
হ্যাঁ, অস্বাভাবিক আবেগ। এই জন্যই তুমি ছেলেকে নিয়ে রাতের বেলা জঙ্গলে যেতে চাইছো।
তোমার কথা ঠিক আছে। আবেগাক্রান্ত না হলে জ্যোৎস্না দেখা যায় না। জ্যোৎস্না, বৃষ্টি, সমুদ্র, পাহাড়, বন-বনানি, শিশির এসবের সাথে আবেগের একটা সম্পর্ক আছে। আর সে আবেগের জন্য মনোচিকিৎসকের কাছে যেতে হয় না। তাহলে কবি-সাহিত্যিকদের সাথে মনোচিকিৎসক বেঁধে রাখতে হত। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী লেখক হুমায়ূন আহমেদ হতেন বিশাল রকমের মনো সম্যস্যায় আক্রান্ত মানুষ।
তুমি হুমায়ূন আহমেদ না। পারবে এক কলম লিখতে? তাঁর বৃষ্টিতে ভেজার মধ্যেও উদ্দেশ্য থাকত।
তাঁর মত লেখার হাত না থাকলেও দেখার চোখ আছে। অহেতুক কথা না বাড়িয়ে চাইলে তুমিও আমাদের সাথে কাল যেতে পার। ভিন্নতর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে।
আর সেই ভিন্নতর অভিজ্ঞতা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে ভাবতে পারলে তোমার শরীরের রক্ত জমে যেত।
ভয়াবহ! জ্যোৎস্নার মধ্যে ভয়াবহ কী আছে?
পাগলামো বাদ দাও প্লিজ। নিজেরা তো মরবেই, তোমাদের সাথে মরবে নিরীহ ছেলে হাসান। গোটা পরিবার তার ওপর নির্ভরশীল।
তুমি যা আশঙ্কা করছো ঠিক তা হবে না। আমাদের কাছে থাকার মধ্যে থাকবে কিছু টাকা আর সেলফোন। গুন্ডা-পান্ডা ধরে যদি তা চায় তো দিয়ে দেব। এখানে জীবন বিপন্ন হবার মত কিছু নেই।
তুমি যদি জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাও তো চলো আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাই। উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়ে সারা রাত আমরা জ্যোৎস্নায় ভিজবো। জ্যোৎস্না স্নান ইংরেজি কি মুনবাথ? হাসানকেও না হয় সাথে নেব।
উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়ে জ্যোৎস্না স্নান, আর বনের মধ্যে ঢিপির উপর বসে জ্যোৎস্না স্নান কী এক হল? আর এত ভয় করছো কেন? নারীরা আজকাল এভারেস্ট, এলব্রুজের চূড়ায় চলে যাচ্ছে।
তুমি যাও এলব্রুজের চূড়ায়, কিছু বলবো না। সে মুরোদ হবে?
আমার ভেতর তো অভিযাত্রিক মন নেই-আছে কবি মন। কবি মন নিয়ে.......।
আহারে আমার কবি! তার মানে.....?
তার মানে আমি যাবই।
তাহলে আমি গলায় কলসি বেঁধে সাগরে ঝাপ দেবই।
সে জন্য একটু অপেক্ষা করো। যদি আমরা জ্যোৎস্না স্নানের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসি, তাহলে তোমার সাগরে ডুবে মরার কোনো কারণ নেই। আর যদি ফিরে না আসি-যদি আমাদের জীবন বিপন্ন হয়, তাহলে তোমার বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। স্বামী ও একমাত্র পুত্রকে হারানোর পর বেঁচে থাকা মানে কষ্টে কষ্টে দগ্ধ হওয়া। তখন সাগর-নদী-খাল-বিল-ডোবা-নালা যেখানে পার ডুব দিও। [ক্রমশ...]


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট