জাদুঘরের নাম কষ্ট
ইজাজ আহমেদ মিলন
স্বপ্ন ভঙ্গের রক্তে প্লাবিত হৃদয়। রাতের আধাঁরে বাড়ির আঙ্গিনায় পালাক্রমে সব আসে , শুধু আসে না তন্দ্রা। দিন কাটে তো রাত কাটতেই চায় না। কত দিন আর এভাবে নির্ঘুম থাকা যায় ? কী এক অদৃশ্য হাহাকারের মধ্যে ডুবে আছেন অপূর্ব রায়হান। মাঝে মাঝে আতœহত্যা করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এই জীবনটাকে অপূর্ব অসম্ভব ভালোবাসেন। জীবনের চেয়ে পৃথিবীতে দামি আর কী আছে ? প্রশ্ন করে নিজেকে।
শরতের বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে সবুজ ঘাসে ওপর শুয়ে অপূর্ব সাদা মেঘের খেলা দেখছিলেন। ঘড়ির কাটা তখন রাত আড়াইটার ঘরে। শরীরের ওপর পড়তে থাকে হালকা কুয়াশা। দু’একটা পাখির ডাকাডাকি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। নীরব নিস্তব্ধ চার দিক। গলা ফাটিয়ে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু চার দিকে বাড়ি ঘর। কান্নার শব্দে যদি কারো ঘুম ভেঙ্গে যায় - এই চিন্তা থেকে অপূর্ব অনেক কষ্টে কান্না নিবারণ করলেন।
কেউ জানে না তার এই কান্নার রহস্য ভেদ , কাউকে জানাতেও চাননা। কেন তিনি হাহাকারের মধ্যে ডুবে আছেন , ক্লেদাচ্ছন্ন বুকের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়, টের পান অপূর্ব। কার জন্য এতো বেদনা ? অসীম দু:খ কষ্ট বুকের ভেতর জিইয়ে রেখেছেন তিনি, সইছেন একাই। এ সব থেকে হালকা হতে চান , কিন্তু দু:খ- কষ্টই তার পিছু ছাড়ে না।
শ্রাবন্তীর হাতে লেখা চল্লিশটা চিঠি অপূর্বের কাছে আছে। রাত জেগে জেগে পুরনো ওই চিঠিগুলো পড়েন। চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। হাসেন মাঝে মাঝে। ভাবের জগতে চলে যান কখনো কখনো । প্রতি রাতে কাজ একটাই । শ্রাবন্তীর চিঠি পড়া। এ ঘোর থেকে অপূর্ব কিছুতেই বের হতে পারছেন না। কোন কথা যখন ফোনে বা সরাসরি বলতে দ্বিধা হতো তখন শ্রাবন্তী ওই চিঠিগুলো লিখেছিল অপূর্বকে।
হঠাৎ এক অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এলো। কষ্ট থেকে নিজেকে হালকা করার একমাত্র উপায় হলো কান্না করা। কাঁদলে মনের দু:খ কষ্ট অনেকটা হালকা হয়। এ কথা অপূর্ব শুনেছিলেন তার প্রয়াত দাদার মুখে। কিন্তু সচরাচর সবায় কাঁদতে পারে না।কাঁদার জন্য চাই একটি উপযুক্ত পরিবেশ।অপূর্ব রায়হানের মাথার চুল,ভ্রু, শরীর আর হাত - পা সবই কুয়াশায় ভিজে গেছে। অদ্ভুত এক চিন্তায় আসক্ত হয়ে একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছেন। রাত তখন তিনটা পনেরো মিনিট। জোৎস্না রাত। আম্রপালি আম গাছের ডালে বসে এক দোয়েল যুগল শিষ দিচ্ছে । দোয়েলের শিষেও যেন কান্নার গন্ধ।
অপূর্বের মাথায় অদ্ভুত এক চিন্তা এলো। তিনি একটা জাদুঘর বানাবেন।এর নাম হবে ‘ জাদুঘরের নাম কষ্ট’। যার যতো দু:খ বেদনা, হাহাকার আর কষ্ট আছে তারা জাদুঘরে আসবেন। দু:খ কষ্ট হালকা করতে পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে কাঁদবেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জাদুঘরে থাকবে কান্না আসার মতো সকল পরিবেশ। যার যে দু:খ, সেটা মনে হলেই পরিবেশ তাকে কাঁদাবে। বিউগলের করুণ সুর থেকে শুরু করে সব ধরণের সঙ্গীতই থাকবে জাদুঘরে। যে সঙ্গীত শুনলে কষ্ট আরো বেড়ে যায় বহুগুণে। শুধু তাই না প্রিয়জন হারানোর বেদনা প্রবলভাবে মনে করিয়ে দেবে সেখানকার পরিবেশ। এই পরিবেশে না কেঁদে আর উপায় থাকবে না। উন্নতমানের সব যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে গড়া হবে জাদুঘরের এ পরিবেশ। তবে এ কান্নার পরিবেশকে যান্ত্রিক বলা যাবে না , প্রাকৃতিক পরিবশই মনে হবে।
পাথরের ব্যবসা করে বারো বছরে কয়েক কোটি টাকা ব্যাংকে জমিয়েছেন। সে টাকা ব্যায় করার মতো তার কোন ক্ষেত্র নেই। বাবা মা মারা গেছেন ছোট বেলায়। আপন জন বলতে কেউ নেই তার। শ্রাবন্তীর পেছনে কিছু খরচ করতেন, কিন্তু সে তো আর এখন নেই। পয়ত্রিশ বছরের অপূর্ব বিয়ে করেন নি। জীবনে বিয়ে করার ইচ্ছেও নেই। যাকে বিয়ে করার কথা ছিল সে এখন অন্য কারো বধূ। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শয্যাসঙ্গী ছাড়াই তিনি জীবন পার করে দেবেন। যে কষ্ট শ্রাবন্তী তাকে দিয়েছে , সেটা পৃথিবীর সমস্ত কষ্টকে হার মানাবে। অপূর্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শ্রাবন্তী নামে রূপবতী ও নানা গুণে টইটুম্বুর এক সহপাঠীর সাথে ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। শ্রাবন্তীর নানা প্রতিভায় মুগ্ধ অপূর্ব শ্রান্তীর প্রস্তাবেই একদিন রাজি হয়ে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়েন। অনেক দিন চলে সে প্রেম। অপূর্বকে ছাড়া শ্রাবন্তীর একদিনও চলে না। অপূর্ব বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ব্যবসায় ঢুকেন। থাকেন ঢাকায়। প্রতিদিন দেখা হয় দু’জনের । কথা হয়। আড্ডা জমে চাইনিস রেস্টুরেন্টে। সংসার গড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল দ’ুজন। হঠাৎ কী এক ঝড় এসে সব এলোমেলো করে ফেলে। ঝড়ের সে কথা বলছি পরে।
জাদুঘর তৈরির চিন্তায় আচ্ছন্ন অপূর্ব সবুজ ঘাসের ওপর শুয়েই রাত পার করে দিলেন। কান্না করার জাদুঘর তৈরির নেশা তাকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ঘন সবুজে আচ্ছাদিত নিরিবিলি একটা এলাকা খোঁজতে লাগলেন জাদুঘরের জন্য। অবশেষে পেয়েও গেলেন। বৃন্দাবন এলাকায় অল্প দামে কিনে ফেলেন ৬ বিঘা জমি। ততদিনে বছরখানেক সময় পার হয়ে গেছে। শহর থেকে ষাট মাইল উত্তরে । রাস্তা ঘাট ভালো না । অনেক কষ্টে যেতে হয় ওই এলাকায়। অপূর্ব যে এরকম মাঝে মাঝে পাগলামী করে সে কথা শ্রাবন্তী জানতো, এমন পাগলামী শুধুই শ্রাবন্তীর জন্য। অন্য কেউ জানতো না সেটা। নানা কষ্টে যাদের বুকের ভেতর কষ্টের পাহাড় জন্মেছে তাদের জন্য একটা জাদুঘর তৈরির কথা অপূর্ব বহুবার বলেছে শ্রাবন্তীকে। কিন্তু নিজেকেই যে এ জাদুঘর বানাতে হবে সেটা অপূর্ব কখনো ভাবেনি। প্রিয়তমার জন্য যদি সৌধ বা মহল গড়তে পারে মহৎ প্রেমিকরা তাহলে প্রিতমার দেওয়া কষ্টকে বেগবান করার জন্য এমন জাদুঘর তৈরি করা খুব স্বাভাবিক বলে অপূর্বের যুক্তি।
ক্রয়কৃত জমির ওপর সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলেন অপূর্ব। বড় বড় হরফে তাতে বাংলায় লেখা রয়েছে-
‘ জাদুঘরের নাম কষ্ট ( প্রস্তাবিত)
‘দু:খী জনেরা আসুন , কাঁদোন মন খুলে’
প্রতিষ্ঠাতা: অপূর্ব রায়হান
নিমার্ণ কাজ চলছে
এই সাইনবোর্ড দেখে এলাকাবাসীর মধ্যে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। সবাই জানতে চায় এর মানে কী ? কত জাদুঘরের নাম শুনেছি ‘ জাদুঘরের নাম কষ্ট’ এরকম অদ্ভুত নাম তো শুনিনি কোন দিন । এমন প্রশ্ন এখন এলাকাবাসীর মুখে মুখে। নিমার্ণ কাজের কোন শ্রমিক এর উত্তর দিতে পারেনা। পারার কথাও না। এর ব্যাখ্যা শুধু অপূর্বই জানেন। জানেন আরেক জন , তিনি আর্কিটেকচার ইমন চৌধুরী। কিন্তু এলাকাবাসী অপূর্বকে ধরতেই পারে না। রাতে আসে আবার ভোর হওয়ার আগেই চলে যায়। এলাকার দু’একজন যারা তাকে জমি কিনতে সহযোগিতা করেছেন ,তারা ওখানে থাকলেও এর ব্যাখ্যাা জানে না। বরাদ্দকৃত বাজেটের দ্বিগুণ টাকা লাগছে। টাকা জোগাড়ে ব্যস্ত অপূর্ব। এক বছরের মধ্যেই কাজ শেষ করার কথা। দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে । সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে তার।
বাবা মারা যাবার পর জীবনের ছন্দ পতন ঘটলেও শ্রাবন্তীর মতো একজন নারীকে কাছে পেয়ে অপূর্ব ভাগ্যবানই মনে করেছে নিজেকে। আগের ছন্দ ফিরে পায়নি যদিও কিন্তু বেশ পরিপাটি সাজানো গোছানো ছন্দবদ্ধ হয়ে চলছিল জীবন। বাবা মাকে হারানোর বেদনা ভুলতে না পারলেও স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করেন অপূর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্ব। সড়ক দুর্ঘটনায় তারা দু’জনই মারা গেছেন। বাবার সহায় সম্বল যা ছিল তা বিক্রি করে পড়া শোনার ইতি টেনে ব্যবসা শুরু করেন। অল্প দিনের মধ্যেই শ্রাবন্তীর সাথে অপূর্বের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে যায়, জীবনে ছন্দপতন ঘটে আবার ।
বিকেল থেকেই তীব্র শীত । শীতের কারণে মানুষজন একটু আগেই বাড়ি ফিরছে। রাস্তা ঘাট অনেকটা ফাঁকা। ব্যস্ততার কারণে দিনের বেলায় শ্রাবন্তীকে ফোন দিতে পারেনি অপূর্ব। বহুদিন পর এই প্রথম দিনের বেলায় অপূর্ব ফোন দেয়নি শ্রাবন্তীকে। শীতের তীব্রতা যতই হোক রাতে শ্রাবন্তীর সাথে দেখা না করে বাসায় ফিরবে না অপূর্ব। দিনের বেলায় ফোন না করায় নিশ্চয় শ্রাবন্তী অভিমান করেছে - ভাবতে থাকে অপূর্ব। তার অভিমান ভাঙ্গাতে হবে। সেটা অবশ্যই ফোনে নয় , সাক্ষাতে। কিন্তুু শ্রাবন্তী যে অভিমান করেছে , সে অভিমান ভাঙ্গার নয়। এটা অপূর্ব জানেন না।
শ্রাবন্তী খুব ভালো গান গাইতে পারে। নাচতে পারে, পারে অসাধারণ আবৃত্তি। বিভাগীয় পর্যায় থেকে জাতীয় আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় এক বার দেশ সেরা আবৃত্তিকার নির্বাচিত হয়েছিল। এখন সে রবীন্দ্র সঙ্গীতে তালিম নিচ্ছে।রবীন্দ্র সঙ্গীতে তার কণ্ঠ অতুলনীয় । শিক্ষক জাহিদ হোসেন খান। জাহিদ দেশের নামকরা তরুণ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। শ্রাবন্তীকে গান শিখাচ্ছেন বছরখানে হলো। শ্রাবন্তীর পরিবারের সকলের প্রিয় জাহিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্স্টাস শেষ করে গান করার পাশাপাশি একটা ব্যাংকে ম্যানেজার পোস্টে চাকরি করছেন। শ্রাবন্তীদের গ্রামের পাশের গ্রামের ছেলে। ছোট বেলা থেকেই শ্রাবন্তীর বাবা রফিকের পছন্দের ছেলে জাহিদ। বাবার ইচ্ছেতেই জাহিদের কাছে গান শিখছে শ্রাবন্তী। জাহিদের বাবাকে ডেকে এনে প্রথমে রফিক সাহেব তার মেয়েকে জাহিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। রফিকের বাবা কোন শর্ত ছাড়াই রাজি হয়ে যান। রফিক সাহেব অঢেল সম্পত্তির মালিক । সে তুলনায় জাহিদরা কিছুই না। শ্রাবন্তীর সাথে বাবার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো। সব কথা শেয়ার করেন দু’জনই। কিন্তু অপূর্বের সাথে গভীর সর্ম্পকের কথা বলেনি কখনো। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ওই দিন সকাল বেলায় রফিক সাহেব শ্রাবন্তী ফোন করে বলেন-
: তোমার পরীক্ষা শেষ কবে ?
: বাবা আজি শেষ হলো।
: কাল বাড়ি আসতে পারবে ?
: ক্যান বাবা ?
: ফোনে বলা ঠিক হবে?
: ক্যান ? কোন সমস্যা ?
:না
: তো ?
: আচ্ছা বলোতো মা , জাহিদ কেমন ছেলে?
: হঠাৎ এ প্রশ্ন ক্যান বাবা ?
: না এমনিতেই, বলো
: অসাধারণ মেধাবী ছেলে। তাছাড়া ভদ্রতা আর বিনয়ে কেউ তাকে পেছন ফোলতে পারবে না।
: আমি ওকে খুব পছন্দ করি । অনেক আগে থেকেই তোমার জন্য জাহিদকে আমি পছন্দ করে রেখেছি। ওর বাবাও রাজি আছে।
: এ ব্যাপারে তোমার মতামত জানার জন্য মূলত তোমাকে আসতে বলছিলাম।
শ্রাবন্তীর বয়স যখন চার বছর তখন তার মা মারা যায় । মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রফিক সাহেব আর বিয়ে করেননি। বাবার জন্য একটা দরদ অনুভব করলো শ্রাবন্তী। কোন ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বাবার কথায় সম্মতি দিলো । এ সময় আকাশটা যেন ভেঙ্গে মাথায় পড়লো তার। অপূর্বের কথা তখন তার মনেই ছিল না। বাবার কথায় শ্রাবন্তী তার জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা কীভাবে অপূর্বকে বলবে এই ভাবনায় দিন চলে যায়।
তীব্র এই শীতের সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে গিয়ে শ্রাবন্তীর সাথে দেখা করার প্রস্তুতি নিতে থাকে অপূর্ব। এ সময় হঠাৎ মোবাইলে ফোন । শ্রাবন্তী ফোন করেছে।
: হ্যালো..
: সরি আজ ব্যস্ততার কারণে তোমাকে ফোন করতে পারি নাই। আমি আসিছি
: ব্যাপার না। আসো। কথা আছে।
: ঠিক আছে
: কতক্ষণ লাগবে?
:তিরিশ মিনিট
ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল শ্রাবন্তী। আর ভাবছিল বিষয়টা কীভাবে বলা যায় ? অপূর্ব সময়ের আগেই হাজির। সবুজ ঘাসের ওপর দু’জন বসে । অপূর্ব তার ব্যস্তার কথা বলছিল। কিন্তু শ্রাবন্তী ছিল অন্য মনষ্ক।
: অপূর্ব! আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কোন সন্দেহ নেই এতে। কিন্তু আমার বাবার কথার কাছে ভালোবাসা হার মানছে। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে জাহিদের সাথে। আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে বিষয়টি না বলেও পারতাম। সরি অপূর্ব ! আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার কোন প্রশ্ন শুনবো না। শুনবো না কোন উত্তর।
অর্পূবের দু’ চোখ থেকে গাল গড়িয়ে জল পড়তে থাকে। কণ্ঠনালী যেন কেউ চেপে ধরেছে। বাকরুদ্ধ অপূর্ব। শ্রাবন্তী তার কথাগুলো বলে চলে যায়। অপূর্ব বসেই থাকে সেখানে। নিজেই শান্ত করতে চেষ্টা করেন। বাসায় ফিরে যায় দু’ঘণ্টা পর।অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। বেশ কিছু দিন অপূর্ব বাইরে বের হন নি।অনেক সময় চলে গেছে।কিন্তু শ্রাবন্তীর কথা ভুলতে পারেন না।ভাবেন স্বামী নিয়ে হয়তো শ্রাবন্তী ভালোই আছে। ভালো থাকুক। নিঘুর্ম থাকতে থাকতে দু’চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে।
জাদুঘরের কাজ শেষ প্রায়। এখন উদ্বোধনে প্রস্তুতি। কবে উদ্বোধন করা যায়? পৌষের সাত তারিখ বেছে নিলেন। যে দিন শ্রাবন্তীর সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটেছিল। উদ্বোধন করবেন দুখু ভদ্র। তিনি নামকরা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশের সব টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনাও আছে। অসম্ভব রকমের সুন্দর হয়েছে জাদুঘর। জাদুঘরের দিকে তাকালেই মন কেমন হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে শ্রাবন্তীর গর্ভে জন্ম নেয় এক ছেলে। বয়স পাঁচ বছর। সংসারে অশান্তি যেন স্থায়ী আসন গেড়েছে। পারিবারিক কলহের কোন সীমা নেই। প্রায় সময় কেঁদে সময় কাটায় শ্রাবন্তী। এখন গান কবিতা বা নাচার কথা যেন শ্রাবন্তী ভুলেই গেছে। পরকীয় আসক্ত জাহিদ দিনের পর দিন বাড়ি ফিরে না। খোঁজ নেয় না স্ত্রী সন্তানের। এ সব কথা কার কাছে বলবে শ্রাবন্তী। বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে। এক শিল্পপতির স্ত্রী লিলির পরকীয়ায় আসক্ত হয়েছে জাহিদ। লিলি একদিন জাহিদকে বলে যে তোমার স্ত্রী সন্তানকে বাদ না দিলে আমার কাছে আসতে পারবে না। মন খারাপ হয়ে যায় তার। বাসায় ফিরে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শ্রাবন্তীকে প্রচন্ড রকম নির্যাতন করে জাহিদ। লোহার দা গরম করে ছ্যাঁকা দেয় শরীরের বিভিন্ন স্থানে। অবচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে শ্রাবন্তী। জাহিদ ভেবেছিল সে মারা গেছে। মজা কিনে দেওয়ার কথা বলে পাঁচ বছরের সন্তানকে নিয়ে বের হয় জাহিদ। মজা কিনে বাসায় ফিরে জাহিদ। সাথে নিয়ে আসে কীটনাশক। মজার সাথে কীটনাশক মিশিয়ে খাওয়ায় ঔরসজাত সন্তানকে। শ্রাবন্তীকে মারপিট করার সময় সে বাসার ছাদে খেলা করছিল।
: বাবা তুমি কোথায় যাচ্ছো ? আমি আমি যাবো তোমার সাথে
: না বাবা আমি কাজে যাচ্ছি
: তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু, আজ রাতে তোমার বুকে ঘুমাবো । তুমি কোথায় থাকো, তোমার জন্য আমার খারাপ লাগে।
: আচ্ছা বাবা, তুমি আম্মুর সাথে থাকো
: আমি তাড়াতাড়িই ফিরবো।
এই অবুঝ শিশুর কথায় মোটেও গললো না জাহিদের পাথর হৃদয় । শ্রাবন্তী পড়ে আছে বিছানায় । জ্ঞান ফিরে দেখে জাহিদ বাসায় নেই। পাঁচ বছরের ছেলে ছটফট করছে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। আশেপাশের লোকজনকে ডাকাডাকি করছে। এই এই ভর দুপুরে কারো কানেই তার ডাক পৌঁছছে না। ছেলে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। শরীরে পোড়া স্থানগুলোতে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছে না শ্রাবন্তী।
গর্ভজাত সন্তান চোখের সামনে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, সইতে পারছে না শ্রাবন্তী। দগদগে শরীর নিয়ে বোরকা পড়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যায়। মজার সাথে সন্তানকে যে কীটনাশক খাওয়ানো হয়েছে তখনও জানেনা শ্রাবন্তী। ততক্ষণে আদরের মানিক চলে গেছে পরপারে। ডাক্তার এসে বললেন সরি! বাচ্ছাটা কীটনাশ খেয়েছে। আর দশ মিনিট আগে আনলে বাঁচানো যেতো। হাসপাতালে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ছেলের লাশ পড়ে থাকে বেডের ওপর। এ সময় তার পাশের বাসার রহিম শেখ কী এক কাজে গেছেন হাসপাতালে। শ্রাবন্তীেেক দেখে আঁতকে উঠেন রহিম। ফোন করেন জাহিদকে । কিন্তু মোবাইল বন্ধ। ওই দিনই জাহিদ লিলিকে নিয়ে রাঙামাটি বেড়াতে যায়। স্ত্রী সন্তানের খবর রাখার তার সময কই ?
অনেক কষ্টে রহিম সাহেব শ্রাবন্তীর এক আতœীয়ে নাম্বার সংগ্রহ করে বিষয়টি জানান। ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় শ্রাবন্তী। তারপর আর জাহিদের বাসায় ফিরেনি সে। শরীরে পোড়ার ঘা শুকিয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সময় কাটে। বনানী কবরস্থানে গিয়ে পুত্রের সমাধির পাশে কাটান ঘণ্টার পর ঘণ্টা। থাকে ওই আতœীয়’র বাসায়্ । হঠাৎ তার মনে পরে অপূর্ব প্রায় বলতো কষ্টের জাদুঘরের কথা। আসলে আছে কি কোথাও এমন জাদুঘর। যেখানে গিয়ে কেঁদে হালকা হওয়া যায়। আর সইতে পারছে না। একদিন শহরের এক দেয়ালে লাগানো পত্রিকার ওপর চোখ পড়ে শ্রাবন্তীর। লোকজন দাঁড়িয়ে দিনের পত্রিকা দেখছে। শ্রাবন্তীও দাঁড়ালো পত্রিকা দেখতে। ব্যাক পেইজের ডান দিকে কর্ণারে লাল হরফে লেখা ‘ জাদুঘরের নাম : কষ্ট ’এর উদ্বোধন। কষ্টের একটা পাহাড় বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো শ্রাবন্তী পড়ে খবরটা। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে কাগজ কলম নিয়ে ঠিকানা লিখে।
যে উদ্দেশ্যে জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে অপূর্ব এখনো যায়নি সে উদ্দেশ্য পূরণ করতে। প্রচুর মানুষজন আসছে। স্থায়ীভাবে যারা থাকতে চায় তাদের জন্য করা হয়েছে সু ব্যবস্থা। অনেকাট বৃদ্ধাশ্রমের মতো। খাওয়া দাওয়া ফ্রি। অপূর্ব অপেক্ষায় আছেন পূর্ণিমা রাতের। অসংখ্য পূণির্মা রাত কেটেছে প্রিয়তমা শ্রাবন্তীর সাথে। এ রাতে তিনি ঢুকবেন তার কষ্টের জাদুঘরে। কাঁদবেন। চাঁদ যেন তার সমস্ত জোৎস্না ঢেলে দিয়েছে পৃথিবীকে। রাত আটটা। বাইরে পায়চারি করছেন অপূর্ব। হঠাৎ দেখেন ফটকের সামনে রিক্সা থেকে একজন মহিলা নামছেন। আস্তে আস্তে হেঁটে আসেছেন জাদুঘরের দরজার দিকে। শুকনো শরীর। কাঁধে ঝুলানো একটা ব্যাগ। রোগাক্রান্ত মনে হলো। হাঁটা অনেকটা শ্রাবন্তীর মতো।
ওটা কি শ্রাকন্তী ? শ্রাবন্তী এখানে আসবে কেন? ও তো মহা সুখে থাকার কথা। ওর তো কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। ভাবতে থাকেন অপূর্ব। রিসিভশনে মহিলা যাওয়ার দু’ মিনিট পর অপূর্ব ঢুকলেন। ততক্ষণে নাম লিখে সে চলে গেছে কষ্টের কক্ষে। তার সাথে দেখা হলো না। অপূর্ব রিসিভশনে জিজ্ঞেস করলেন এইমাত্র ঢুকলেন যে মহিলা তার নাম কী লিখেছে ? ওখান থেকে জবাব আসে ‘ শ্রাবন্তী’।
ধানশালিক ইউটিউব চ্যানেল । সাবস্ক্রাইব করে পাশে থাকুন : https://www.youtube.com/watch?v=7_bEP0d9Rm4