বাজি
আহাদ আদনান
ধানশালিক ইউটিউব চ্যানেল । সাবস্ক্রাইব করে পাশে থাকুন : https://www.youtube.com/watch?v=7_bEP0d9Rm4
মাঝরাত। শহরের অদূরে গ্রাম পেরিয়ে হাউজিং গড়ে উঠেছে। খোলা একটা প্লটে
দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলেছে জয়নাল। কুয়াশা আর
নিকোটিনের মিথস্ক্রিয়া চিন্তাশক্তি ভোঁতা করে দিচ্ছে। এরকম ভোঁতা মস্তিষ্ক
কবিতা কিংবা গানের জন্য অনবদ্য। কিন্ত জয়নালের ভোকাল কর্ডের চারপাশে কিছু অশ্রাব্য গালি কিলবিল করছে এখন। কারণটা খুব বিরক্তিকর প্রকট হয়ে বসে আছে।
‘স্যার, একটা সিগারেট হবে?
জয়নাল অনেক কষ্টে গালি আটকে রেখেছে।
‘তাইলে অন্তত কয়েকটা টান দিতে দেন। আমার মুখে রক্ত জমা গন্ধ বাইর হচ্ছে। আমার টানের পর আপনি আর মুখে দিতে পারবেন না। আপনার খাওয়া কাঠিটা দিলেও চলবে’।
‘পুত, ফোনটা আইলেই তোরে ফালায়া দিমু। মরণের আগে আল্লাহ খোদার নাম নে। একটা কথা কইলে আগুন..দিয়া হান্দাইয়া দিমু’।
ধমকে কিছুটা কাজ হল। খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা। দূরে কিছু আগেও শেয়াল কুকুরের কোরাস ভেসে আসছিল। এখন চারদিকে হিরন্ময় শীতলতা।
এস আই জয়নাল কে রেখে আর দুই বস কোথায় যেন গেছে। ঘন্টা খানেক পার হয়ে যায় কোন হদিস নেই ওদের। ফোনও ধরছে না। বারবার ফোন দেওয়া জুনিয়রের জন্য বেয়াদবী। জয়নালের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মনে হয় জানে ওরা কোথায়। নিস্তব্ধতা ছিড়ে দিল কিছু অর্থহীন উষ্মা।
‘বাচ্চা দুইটা গেছে মাল খাইতে। এইটার লগে যদি তোদেরও ক্রসফায়ারে ফালাইতে পারতাম!
‘দেন না স্যার একটা টান।
‘মাগনা আমি বউরে চুমাও খাইতে দিই না। আর তুই, ফোনটা পাইলেই বুকে, না না, ক্রসফায়ারের গুলি পিঠে করা লাগে,তোরে দিমু সিগারেট?
‘স্যার এত কিপ্টামি কইরেন না। সাপে খাইব।
‘হাউজিংয়ে সাপ আছে'?
‘সাপ ভয় পান মনে হয়? কথার কথা কইছি। মাইন্ড কইরেন না। সাপ খাইব কেন? যম পর্যন্ত আপনাদের ভয় পায়। ফণা তুললেই কইবেন, আমি পুলিশ। ভয়ে পেশাব কইরা দিব দৌড়’।
‘তোরে আনছি ক্রসফায়ারে দিতে। ভয় করছে না?
‘ভয় কাটাইতেইতো ধোঁয়া চাইছি।
‘খুন তো মনে হয় তিনটা করেছিস। খুন করার আগে কাওরে কখনও দয়া দেখাইছিলি? মনে পড়ে কিছু? মৃত্যুর আগে চেহারা কেমন হয়, মনে পড়ে?
‘তিনটা না, সতেরোটা। সব কি আপনাদের ফাইলে থাকে? আপনি এস আই। আপনাদের বসদের বস অবশ্য জানে সব। খুন সতেরো, কিডন্যাপ পঁচিশ-ছাব্বিশ, ধর্ষণ ত্রিশটার মত। এই লাইনে এতকিছু মনে রাখার নিয়ম নাই। আমি হুদাই সব মনে রাখি। কেন জানেন’?
‘কেন’?
‘একটা সিগারেট দেন, কইতাছি’।
‘তুই আলিফ লায়লা পাইছিস আমারে? গল্প বলার ব্ল্যাকমেইল করে সুবিধা নিবি। আমার গল্প শোনার কোন মুড বা ইচ্ছা নেই’।
‘স্যার, গুলি কি আপনি নিজে করবেন’?
‘কেন, আমি করলে সমস্যা আছে’?
‘না, ধরেন গুলি জায়গামত লাগল না। আহত হইয়া পইরা থাকলাম। পরে সুযোগ বুইঝা ফুড়–ৎ। আপনাকে দেইখা মনে হয়না ক্রসফায়ার করছেন আগে’।
কয়েক মিনিট শুনশান নীরবতা। চোখের খেলা চলছে দুজনের। পার্থক্য একজনের হাত আর মুখ ব্যস্ত, আরেকজনের হাত, পা সব বাঁধা।
‘গুলি আমার করার কথা ছিল না। আমার বসের করার কথা। ডেথ শিউর হওয়ার পর উপরে ফোন দেওয়া হবে। দুধর্ষ সন্ত্রাসী মকবুলকে নিয়ে গোপন আস্তানা আর অস্ত্রের মজুদের উদ্দেশ্যে অভিযানে বের হওয়ার পর একসময় সে পালাতে চেষ্টা করে। আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা তার সাথীরা পুলিশের উদ্দেশ্যে গুলি
ছুড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ে। একপর্যায়ে মকবুল গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরিচিত সাংবাদিকদের কাছে মেসেজ আছে। গ্রীন সিগন্যাল পেলেই কাগজে, ইন্টারনেটে খবর চলে যাবে’।
‘আপনার গ্রীন সিগন্যাল মানে আমার রেড সিগন্যাল’।
একটা ফোন আসল ঠিক তখনই। কয়েক মিনিট কথা চলল।
‘আমারে ভালো করে দেখে রাখ। আর দশ মিনিট। তারপরেই সব খতম। ......বাচ্চা দুইটা মালে ডুইবা আছে। গুলি আমিই করব’।
‘আল্লাহ আপনারে সফল করুক। আমিন। এক গুলিতেই আমার খুলি উড়ে যাক। আমিন। স্যার, একটা বাজি ধরবেন’?
‘কি বাজি’?
‘আপনি যেই ব্র্যান্ডের সিগারেট টানছেন এর দাম বারো টাকা। যেই হারে টানছেন তাতে পাঁচ-ছয় দিনে এক মাসের বেতন শেষ হওয়ার কথা। তার মানে আপনি খুব উচু পর্যায়ের ঘুষখোর। আমি অবশ্য ইমপোর্টেড ছাড়া টানতাম না। বাজিটা হচ্ছে, একটা কাঠি আমি এক লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিব। টাকা দিতে পারলে বাজি আমার। আপনি আমারে একটা সিগারেটের কাঠি দিবেন। আর হারলে ক্রসফায়ার।’।
‘তুই আমারে এক লাখ টাকা দিবি? এই শুনশান রাইতে, হাত-পা বাঁধা, পকেট খালি, দশ মিনিটও আয়ু নেই, আর তুই টাকা দিবি? আর আমি বিশ্বাস করব’?
‘মকবুলের বাজি মানে বাজি। খোদার কসম এক লাখ টাকা আপনি পাবেন। কসম’।
সিগারেট টানার গতি আরও বেড়ে গেছে।
‘তুই কি আমার মোবাইল দিয়ে কাওকে কল দিতে চাস’?
‘কল দিতে পারি কিন্তু দিব না। এই কাজ আপনিও করবেন না। ধরেন লাস্ট কলটা কোথাও রেকর্ড হয়ে ভাইরাল হয়ে গেল। আপনার জাঙ্গিয়া নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে’।
‘আমার বসদের মধ্যে কারও সাথে তোর খাতির আছে’?
‘নাহ! এত ছোট অফিসারদের আমি হিসাবে ধরি না’।
‘তাইলে’?
‘বললে সিগারেট দিবেন’?
‘দিব। কসম’।
আধা মিনিট সব চুপ।
‘পাঁচ বছর আগের কথা। তখনও আমি টপ টেরর হই নাই। প্রথম রিমান্ড খাইলাম। এক স্যার পিটাইয়া পায়ের হাড্ডি আর কয়েকটা দাঁত ফেলে দিছিল। এখন যেমন কালচে রক্তে দাঁত কালো হইছে, ঠিক এমন রক্ত’।
হঠাৎ ফোন বেঁজে উঠল জয়নালের। সে ফোন ধরবে, কিন্তু জয়নালের কথা শোনা আরও জরুরি।
‘স্যার, আমার তিনটা দাঁত স্বর্ণের। দুবাই গিয়ে বসিয়েছি। দাম এক লাখ টাকা হবে। আপনাকে দিয়ে দিলাম। বাজি আমি জিতে গেছি। এখন সিগারেট দেন’।
নিজের অজান্তে জয়নালের হাত চলে যায় সিগারেটের প্যাকেটে। জয়নাল চমকে উঠে, প্যাকেট খালি। আর সিগারেট নেই। আরেক হাতে সে ফোন ধরে। ফোন রাখতেই তার হাত চলে যায় ট্রিগারে। নিস্তব্ধতা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলে মকবুলের অট্টহাসি, বিদ্রুপ, শ্লেষ মাখানো চিৎকার। অভিশাপের জিকির।
‘আপনি কথা দিয়ে কথা রাখলেন না স্যার। বাজি আমার, বাজি আমার,বাজি আমার,’।