এবং প্রথমা
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছিল ওরা। প্রথমা আর বিতান। দু’জনের চেনাজানা এমন একটা স্তরে পোঁছায় নি যার ওপর ভর করে অচেনায় পা বাড়ানো যায়। তবুও কেন জানি না প্রথমার মনে হয়েছিল মানুষটাকে পথ চিনে নিতে ডাকা যায়। অনুমান ভুল ছিল না। অনেকটাই পথ হেঁটেছিল দুজনে।
অনেকটা পথ চিনে নিয়েও কোনো লাভ হয় নি প্রথমার। বাড়ির আয়োজনে আবার তাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল। গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার বারিধারায় যেমন কারও হাত থাকে না, প্রথমারও মনে হয়েছিল জীবনের সংখ্যা পর্বের সূচনায় আবার তাকে দাঁড়াতেই হবে। অক্ষমতার কারণে বাধ্য ছাত্রীর মতো আবার তাকে অঙ্ক নিয়ে বসতে হয়েছিল।
কিন্তু যার কাছে অঙ্ক শিখতে আসা তারই কোনো আগ্রহ ছিল না। শিক্ষকের অনীহা কী করে মানিয়ে নেওয়া যায়? হাজার চেষ্টা করেও প্রথমা তাকে বসাতেই পারত না। শিক্ষকের একমাত্র ছাত্রীটিকে প্রথমা একদিন আড়াল থেকে দেখেছিল।
স্কুলের থেকে নাম কাটিয়ে নিজের বাড়িতেই উঠেছিল প্রথমা। প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনোদিনও স্কুলে যাবে না। না, শিক্ষকের ওপর তার রাগ হয় নি। বরং শিক্ষা পেয়েছিল এভাবেই বোধ হয় বেঁকে বসতে হয়। একটাই শুধু প্রশ্ন, ভর্তি হওয়ার আগে কি জানিয়ে দেওয়া যেত না?
সবকিছু জেনেও বিতান আবার অঙ্ক কষাতে রাজি হয়েছিল। অরাজি সে কোনোকালেই ছিল না। শুধু একটু চোখে চোখ রেখে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জোরের সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া। সেটুকুও প্রথমা সেদিন করে নি। নিজেকে চূড়ান্ত স্বার্থপরের মতো মনে হলেও প্রথমা আবার বিতানের কাছে অঙ্ক খাতা না খুলে পারে নি।
একদিন সন্ধ্যে থেকে একটা অঙ্ক নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ল দুজনে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই মিলছে না। বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গেল প্রথমা। তখন কত রাতকে জানে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। পাতার পর পাতা অগণন সংখ্যার হাত ধরে অঙ্ক মিললো। শুধু মাথা নয়, সারা শরীর দিয়ে প্রথমা অনুভব করলো যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলো প্রথমা। অনেকটাই আলো ফুটে গেছে। পেয়ারা গাছের ডালে একটা টুনটুনি ওড়াওড়ি করছে। নিজেকে হালকা লাগছে প্রথমার। এখন সে উড়তেও পারবে।
হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ।