চোর
কিশলয় গুপ্ত
খবরটা দাবানলের মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। প্রাইমারী স্কুলের হেড মাষ্টার বিনয়বাবু মিড'ডে মিলের চাল পাচার করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। স্কুল কমিটির সেক্রেটারী নিজে ধরেছে। গোটা গ্রাম ছি ছি করছে । বাচ্চাদের মুখের খাবার যে কেড়ে নেয় সে আবার মানুষ নাকি? আপাতত চোরের ঠিকানা হাজতে....
পঁচিশ বছর বিনয়বাবু কে চিনি। যে মানুষটার মাস মাহিনার এক চতুর্থাংশ বেরিয়ে যায় অন্যের কাজে সে বাচ্চাদের মিড’ডে মিলের চাল পাচার করবে- একথা আর যে’ই মানুক আমি মানতে পারছি না । গোটা গ্রাম কেন, সারা পৃথিবীর মানুষও যদি বলে আমার কাঁধের ছাগলটা আসলে ছাগল নয়-কুকুর..তবু আমি জানি ওটা ছাগল ।
থানার ছোটবাবুর সাথে কিঞ্চিৎ আলাপের সুবাদে হাজতে বিনয়বাবুর সাথে সাক্ষাৎ এর অনুমতি পাওয়া গেল। দেখে ভালো লাগলো মানুষটা এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মৃদু হেসে আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে যা বললেন, মোটামুটি এই রকম-স্কুল কমিটির সেক্রেটারী অনেকদিন থেকেই প্রলোভন দেখাচ্ছিল মিড’ডে মিলের চাল পাচার করার জন্য। আধাআধি বখরা। কিন্তু বিনয়বাবু সে কথা তো শুনলেনই না তদুপরি সরকারী বুলেট চাল বিক্রী করে নিজের দায়িত্বে মিনিকেট চাল কিনে বাচ্চাদের খাওয়াতেন।
সেক্রেটারীর চক্ষুশূল যে হবেন এতো জানা কথা । যেটা জানতেন না তা হল যে ভ্যানে করে সরকারী চাল পাঠিয়ে ভালো চাল আনতেন- সেই ভ্যান চালক, যে দোকান থেকে চাল কিনতেন- সেই দোকানী, মিড’ডে মিল যারা রান্না করতেন-সেইসব মহিলা... সকলেই সেক্রেটারীর কথায় সায় দিয়ে বিনয়বাবুকে চোর প্রমান করে দিলো। অর্থাৎ পায়ের তালু থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সকলেই দুর্নীতির কাছে বিকিয়ে গেছে।
বলা শেষ করে বিনয়বাবু আমার দিকে তাকালেন। বললেন- ‘আমি কিন্তু বিশ্বাস রাখি সত্যের জয় হবেই’। কিছুই বলতে পারলাম না, নীরবে থানার বাইরে বেরিয়ে এলাম। কাকে চোর বলবো- বিনয়বাবুকে? ভ্যান চালককে? রাঁধুনী মহিলাদের? দোকানীকে? স্কুল কমিটির সেক্রেটারীকে? নাকি...নাকি এই প্রশাসনকে... এই সরকারকে...
শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকালাম। অনেক মেঘ জমে আছে আকাশে। বৃষ্টি হবে কি?
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ ।