একটি বিবাহ বার্ষিকী
আহমদ মেহেদী
সেদিন সিএনজি থেকে নামতে গিয়ে ঠিক বুকের ডানপাশটাতে ব্যথা পেয়েছি । প্রথমে ভেবেছিলাম সেরে যাবে কিন্তু আজ পনের দিন হল ব্যথা কমার নাম নেই । মাসের অর্ধেক হয়েছে মাত্র, পকেট খালি । ভাল একজন ডাক্তার দেখানো দরকার । বেতন পেতে আরও দুই সপ্তাহ বাকি । নতুন অফিসে বদলি হয়ে এলাম মাত্র পাঁচদিন হল । অফিসের কলিগদের কাউকে তো আর চিনি না এই মুহুর্তে । তাদের কাছে হুট করে আর যাইহোক ধার চাওয়া যায়না । এমনিতে ধার দেনা টানতে টানতে দিশেহারা হয়ে পড়ছি । ঘর তৈরির সময় কাছের বন্ধুরা অনেক হেল্প করেছিল। তাদের কারও টাকা দিয়েছি আর কারো টাকা ঠিক কবে দেব তাও জানিনা । এর মধ্যে বেলাল আর সোহেল তাদের টাকা নিয়ে চিন্তা না করতে বলেছে । এই আশ^াসে তখন নিজেকে স¤্রাট হুমায়ুন ভাবতে শুরু করলাম।
এতসব আমার প্রিয়তমা সিমু জানেনা । বাবার পছন্দে তাকে বিয়ে করি ২০১৭ সালে । নি¤œমধ্যবিত্ত ঘরের ভাল একটি মেয়ে । আমাকে তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসে এখন । আমার বুকে মাথা রেখে সে এখন তার অতীতের সকল দুঃখ ভুলে যেতে চায় । আমিও দিনদিন এই সহজ-সরল মেয়েটির নিঃস্বার্থ প্রেমে পড়ে গেলাম । যে প্রেম আমার যৌবনের সকল প্রেমকে হারিয়ে দিয়েছে । পারিবারিক ¯েœহ-মমতা, অনুশাসন-বিহীন বেড়ে ওঠা একজন ছেলের জন্যে যখন কেউ ভাত না খেয়ে বসে থাকে তখন অন্য এক পরিবার, অন্য এক নতুন পৃথিবী আবিস্কারের মতোই মনে আনন্দ পাওয়া যায় । বড় হওয়ার পর আমাকে কেউ ভাত খাইয়ে দিয়েছে- এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি । কিন্তু আমার বন্ধুদের বেলায় অনেক দেখেছি আমি । তাদের মা-অনার্স পড়ুয়া একটি ছেলেকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে-এমন দৃশ্যের চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমি আজও দেখিনি । চারপাশে কত আয়োজন । কারও জন্মদিনের, কারো বিবাহ-বার্ষিকীর , কারো বা মৃত্যু-বার্ষিকীর। জন্মের সঠিক তারিখ না জানার আক্ষেপ আমার চিরদিনের । কিন্তু সিমু আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিকই মনে রেখেছে ।
২৭ জানুয়ারি, আমাদের বিবাহ-বার্ষিকী । আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি । মাথার কাছে বাবা বসে আমার মাথার চুল টেনে দিচ্ছে । সিমু অন্য একটি খালি বেডে ঘুমিয়ে আছে । গত রাতে একটুও ঘুমায়নি সে । জীর্নশীর্ন বাবাকে দেখে ভেতরটা কেমন কেপে উঠল । বাবা আমাকে শান্তনা দিয়ে বললেন- কিছু হয়নি মেহরাব, ডাক্তার ঔষধ দিয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে । বাবা চোখের জলকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করছে ।
-বাবা, মা আসেনি ?
-না তোর মা রুবির শ^শুড় বাড়ি যাবে , তাদের বাড়িতে কি যেন অনুষ্ঠান। না গেলেই নয়, এমনিতে তো কত দোষ আমাদের!
-বুঝতেই পারছিস বাবা, যেদিন মেয়ে বিয়ে দিবি সেদিন বুঝবি ।
সিমুর কাছে কিছু টাকা দিয়ে বাবা বিকালে বাড়িতে চলে গেল । সিমু আমার কাছে এসে বসল । তার তো কাঁদতে কাঁদতে একেবারে চোখ ফুলে গেছে । ঘুমিয়ে থাকার কারনে কিংবা ফুলা চোখের কারনে তাকে বেহেস্তের হুরের মতোই লাগছে । কাঁদো কাঁদো গলায় বলল- তুমি চোখ বন্ধ করতো !
আমি চোখ বন্ধ করলাম। বুঝতে পারছি সে ব্যাগ থেকে কি যেন খুলছে ।
-এবার চোখ খুল ।
চোখ খুলেই বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি- একটি হলুদ রুমালে সবুজ সুতায় তার নিজের হাতে বুণা( ঝ+গ)তার নিচে লেখা ঐধঢ়ঢ়ু সধৎৎরধমব ফধু লধধহ. দুই হাতে ধরে দাড়িয়ে আছে । আর আমার জন্য একটি পেস্ট কালারের শার্ট । কই আমি তাকে আজকের দিনে কিছু গিফট দেব তা না করে.... না । আমি উঠতে পারছিনা দেখে সিমু আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে । সবাই আমাদের দিকে ফেল করে তাকিয়ে আছে । যেন এরকম আর কোথাও আর দেখেনি কেউ । যে যাই দেখুক ,যে যাই ভাবুক তাতে আমার কি আসে যায়- আজ যে আমাদের বিবাহ-বার্ষিকী ।সিমুর কোমরে আমার বা হাত ,তার কপালে চুমো দিতে উঠতে উঠতেই পুরো হাসপাতাল অন্ধকার হয়ে গেল । হয়তো বিদ্যুৎ চলে গেছে।
নোয়াগাঁও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা ।