একজোড়া আঙ্গুলের বাঁধন


একজোড়া আঙ্গুলের বাঁধন
ইয়াকুব শাহরিয়ার

বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ভার্সিটি গেইটে গিয়ে দাঁড়াই। বাসস্ট্যান্ড থেকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় খুব কাছে। পূজোর বন্ধ শেষ হয়েছে। কাল থেকে ভার্সিটি খোলা। সকল শিক্ষার্থীরা হলে ফিরতে শুরু করেছে। তাই গেইটের সামনে প্রচ- ভিড়। ভিড় বলতে হল পর্যন্ত যেতে যে টমটম বা রিকশা পাওয়ার কথা সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে। বেশি দূর হবে না। এক কিলোমিটার হবে। নরমালি পায়ে হাঁটলে পনেরো ষোলো মিনিট বড়জোর বিশ মিনিট লাগে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। কুসুম আসলে পরে একসাথে যাবো, ভিরতে। এরই মাঝে একজন স্ট্রিটহকার এসে আমাকে ‘বরিশালের আমড়া’ অফার করলো। পাঁচ টাকা দাম। গোলাপের মতো করে কাটা আমড়াগুলো রোদে শুষ্কভাব ধরে আছে। এমন আমড়া প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন সি থাকে। খুব উপকারি। রং ফর্সা রাখে। বিশেষ করে স্কার্ভি রোগ এড়াতে এগুলো খাওয়া দরকার। ছোট বেলায় আমি একজন নিয়মিত স্কার্ভি রোগী ছিলাম। আমড়াগুলোর চেহারা পছন্দ হয়নি বলে পকেটের পাঁচ টাকা থেকে গেলো। দূপুরের রোদের পরে বিকেলের আগের রোদটা কড়া থাকে। তাই একটু গরম গরম লাগছিলো।
হঠাৎ করে আম্বরখানা থেকে আসা একটি সিএনজি থেকে কুসুম নেমেই আমাকে ডাক দিলো। আমু...। ভাঙতি পনেরো টাকা আছে? আমার কাছে ছিলো কিন্তু কেনো যেনো মুখ দিয়ে না চলে এলো। পরে সিএনজি ড্রাইভারই যাত্রীদের কাছ থেকে ম্যানেজ করে দিয়েছে। কুসুম নামতেই ওর চেহারার দিকে নজর পরে আমার। শুকনা পাতলা একটা মেয়ে। খুব ভাল লাগছে দেখতে। বোরখা পড়ে না কখনো। তাকে দেখে কখনো মনে হয় নি আলাদা করে বোরখা পড়া দরকার। কারণ এমনিতেই তার পোশাকে সব সময় শ্লীল সে। তার প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস, সম্মান ও স্নেহ কাজ করে। আমি মনে করি এ চার উপাদান না থাকলে ভালবাসা যায় না। সময় কাটানো যায়। আমার কাছে এসে কিছু না বলে আমার মতো করে দাঁড়িয়ে রইলো। জিজ্ঞেস করলাম- কি? ছোট্ট করে সরি বলে- বললো, চলো যাই। আমি বুঝতে পেরেছি কেনো সরি বলেছে। তার কারণে যদি কালো চেহারায় কিছুটা ঘেমে যাই, সোজাসাপ্টা সরি বলতে কোনোদিন দ্বিধা করে নি। ছোট্ট করে একটা হাসি দিয়ে ঘড়ির দিকে থাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

জানি রিকশার অপেক্ষা করা বোকামী। তাছাড়া কুসুম আর আমি যতদিন গেলাম- এলাম ভিতরের এ রাস্তাটা হেঁটেই পাড় হয়েছি। খুব ভাল লাগে এ রাস্তায় হাঁটতে। এ ভার্সিটিতে আমরা কেউ পড়ি না। আমি আর কুসুম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার দুই ইয়ার জুনিয়র সে। দু’জন দুই শহরে। দেখা করতে আমিই ছুটে চলি তার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে শহিদ মিনারের পেছনের দিকটায় গিয়ে বসি। আমাদের সামনে আরো দু’চার জোড়া বসে লুটোপুটি খেলছে। ভাল লাগছে। কুসুম আমার কাছে কিচ্ছু আশা করে না। সান চিপস্ তার খুব পছন্দের। সেদিন দেই নি। হঠাৎ করে করুণ স্বরে বললো- আমু? তার দিকে তাকাতেই দেখি জল গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগলো। কিছু না বলে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিলাম। দু’চার মিনিট পরে ‘কি হয়েছে’ জানতে চাইলে বলে উঠলো- ‘আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি খুব একা। আমার পাশে থাকার মতো তুমিই একজন। প্লিজ, সব সময় থেকো।’ মনে হচ্ছিলো, একাকিত্ব খুব তাড়া করে বেরায় তাকে। শহিদ মিনারের সিসি ক্যামেরাগুলো আমাদের দিকে বড় বড় চোখ করে দেখছিলো। বাকীদের মতো আমরাও লজ্জা পাই নি।
তাকে বাহুডোরে বেঁধে পাশে থাকার আশ্বাস দিলাম। তারপর মুখের দিকে অনেক্ষণ থাকিয়ে বললো- দেশে সেলুন নাই? বন মানুষের মতো দাঁড়ি লম্বা করে রাখছো কেনো? পাগলের বেশে থাকতে খারাপ লাগে না? আর চুল গুলার স্টাইল আদিম যুগের মতো করে রাখছো কেনো? এটা বদলানো যায় না। আমার সান চিপস্ কই? টিশার্টের রং ভাল কিন্তু একটু মোটা।’ আমি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেইনি। কিছুক্ষণ পর উঠলাম দু’জন। অডিটোরিয়ামের দিকে এগুতেই ছোট ভাই একটা পেলো। আজকেই হলে এসেছে। কুসুমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। সে চলে গেলো বাংলা ভবনের দিকে। আমরা অডিটোরিয়ামের ডানদিকের রাস্তায় গিয়ে গার্ডওয়ালে বসলাম। একটা বনোশিয়াল আমাদের দেখে উঁকি দিলো। পরে এদিকে রোদ থাকায় ছায়ার দিকে বসে কথায় কথায় সময় পাড় করি। বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল জড়িয়ে কুসুম বললো- আমু, যদি এই আঙ্গুল গুলোকে সারাজীবন এভাবে একসাথে রাখার কোনো সুপ্রিম ক্ষমতা আমার থাকতো তাহলে আর কোনো ভয় থাকতো না।
-কিসের ভয়?
-যদি কখনো তোমার থেকে দূরে যেতে হয়?
আমি উঠে দাঁড়াই, কনিষ্ঠা আঙ্গুল আর হাত ছাড়া হয় নি। একজোড়া আঙ্গুলের ঘষাঘষি এসে থামে পুচকার দোকানে। আমি চটপটি খেলাম আর কুসুম পুচকা। আমার কাছে পুচকাটা মেয়েদের খাবার মনে হয়। আর চটপটি পুরুষের। ষাট টাকা বিল চুকিয়ে আবার একজোড়া আঙ্গুলের জড়াজড়ি। আবার হেঁটে চলা এক কিলোমিটার কিংবা পনেরো ষোলো মিনিট বড়জোর বিশ মিনিট। তখন গোধূলি সন্ধ্যার বুকে মাথা রাখলো বলে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট