রোমাঞ্চকর সন্ধ্যা
আনোয়ার রশীদ সাগর
সূর্যটা পূর্বদিকে ডুবেই যাবে, বিকেল ছাড়িয়ে গোধুলী ছুঁই ছুঁই করছে। এখন তো আর মাঠের মাঝ বেয়ে দূরে কোথাও রাস্তাও দেখা যায় না, একদল গরু ধূলা উড়াতে উড়াতে বাড়িও ফিরে না।
শুধুই যেন স্মৃতিকথা।
গ্রামের উত্তর মোড়ে সপ্তায় দু’দিন হাট বসে। সে হাটকে ঘিরে ছোট ছোট টোঙ দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছে অনেকেই। প্রায় গ্রামেই এখন হাট বসে, তাই এক গ্রামের লোক অন্যগ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। জাহিদ হাসান ওরফে জাহিদ চারযুগ ধরে পাশের গ্রাম থেকে এই বন্ডবিল গ্রামে চা খেতে আসে। তখন এই এলাকায় একটায় চা’র দোকান ছিল।
মেয়েটি সবুজ শাড়ী আর লাল ব্লাউজ পোরে চা’র দোকানে, একটা কাসার গ্লাসে করে, চা নিতে এসেছিল। সেই যে একবার দেখেছিল মেয়েটিকে, সে দেখার সাধ আর মেটেনি জাহিদের। চল্লিশটা বছর চা খেতে আসে এই দোকানে অথচ মেয়েটি আর একবারও চা নিতে এল না। কোনদিন এই রাস্তা দিয়েও হেটে গেল না। জাহিদ সেই একই সময় চা খেতে আসে, ঠিক সন্ধ্যার একটু আগ দিয়ে।
তখন চা এর দোকানের পাশের বাড়ি থেকে ধুপের গন্ধ আসত। আর এখন টিভি চলার শব্দ শুনা যায়। জাহিদ কোনদিন কাউকে কিছু বলেনি, শুধু মনে মনে ভাবে মেয়েটি আর একদিনও এলো না? -সে কি আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে এসেছিল, নাকি মরে গেছে?
এতটি বছর ঐ বাড়ির ভাঙা টিনের, পুরানো দরজার দিকে, বিকেল হলেই চা খাওয়ার ভান করে, এসে বসে থাকে। এতদিনে টিনের ভাঙা গেটটা গ্রিলের পাতির তৈরি গেট হয়ে গেছে, বাড়ির প্রাচীরটাও রঙিন হয়ে গেছে। আশ-পাশের অনেক কিছুই বদলিয়েছে। শুধু বদলায়নি জাহিদের মনটা, দিন দিন লোহায় জং ধরার মত মরিচা বেড়েই চলেছে মনে।
জাহিদ অনেক মোটা মানুষ। খুব সোজা-সাপ্টা কথা বলে। কিন্তু এই মেয়েটির কথা কোনদিন কাউকে বলতে পারল না। এখন বয়স ষাট বছর ধর্ ধর্ করছে, অপেক্ষার পালা শেষ হয় না।
হঠাৎ যেন প্রাণের ভিতর ছ্যাৎ করে উঠল। কড়ার তপ্ত তেলে, মাছ ঢেলে দেওয়ার মত শব্দ হলো। ধৈর্যের শেষ বেলায় এসে যেন সাধ পূর্ণ হল। ঠিক সেই মেয়েটিই নীল সালোয়ার কামিজের সাথে লাল ওড়না গলায় জড়িয়ে জাহিদের পাশ ঘেষে দাঁড়াল। অবাক করা কান্ড, মেয়েটির বয়স একটুও বাড়েনি? জাহিদ মনে মনে ভাবে তোমাকে আর একবার দেখার জন্য, অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বৃদ্ধ হয়ে গেলাম অথচ তুমি সে রকমই রয়ে গেছো? এও কি সম্ভব?
এবার মেয়েটির দিকে ঘাড়টা উঁচু করে বেশ খানিক সময় ধরে জাহিদ চেয়ে থাকল। তখন পাশ থেকে এক যুবক তার এক বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলল, দ্যাখ্, ‘লালি’ একদম রুপী খালার ফটোকপি। রুপী খালা, এই ‘লালি’ ছুড়ি হওয়ার সময় মইরি গিছ্।
মেয়েটি প্রতিবাদ করল, এই তুই আমাক্ ছুড়ি বুলবিনি?
ক্যান্ বুড়ি বুইলবো? -ছেলেটি প্রশ্নটা করে, মেয়েটির দিকে বেশ কিশোর-মিশ্রিত কামুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। মেয়েটি বেশ বড় করে, জিহ্বা বের করে ছেলেটিকে দেখাল।
এবার যুবকটি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই লালি আমি তোকে বিয়ে কইরবো। লালি পা দাপাতে দাপাতে ও মুখ ভেঙচাতে ভেঙচাতে বলল, আমি নানিক বুইলি দিবোন্।
বলেই ওড়নাটা গলায় জড়াতে জড়াতে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। ছেলেটি তার বন্ধুর গলা জড়িয়ে ধরে লালির দিকে তাকিয়ে থাকল। লালি বাড়ির গেটের ভিতরে ঢুকার আগ দিয়ে আবার জিহ্বা বের করে ‘উঃউঃ’ শব্দ করে রোমান্টিক মাথা দুলিয়ে, হারিয়ে গেল উঠানের দিকে।
আলমডাঙ্গা,চুয়াডাঙ্গা।